সুস্থ মানুষ ও সুস্থ নেতা
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকা-, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘আমাদের অর্থনীতি’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজ পড়-নÑ সু¯’ মানুষ ও সু¯’ নেতা। একটা আরবীয় প্রবাদ দিয়ে শুরু করছি, ‘যার স্বাস্থ্য থাকে তার আশা থাকে, যার আশা থাকে তার সবকিছু থাকে এবং যার আশা নেই তার কিছুই নেই।’১১১ একজন মানুষ সুস্থ থাকলে সুস্থ পরিবার গড়ে ওঠে, সুস্থ পরিবার গড়ে তোলে সুস্থ সমাজ এবং সুস্থ সমাজ গড়ে তোলে সুস্থ জাতি। এজন্য প্রয়োজন হয় নেতৃত্ব এবং খেলাধুলা ও শারীরিক কসরত। সুস্থ মানুষের সঙ্গে সুস্থ নেতার সম্পর্ক ঠিক সুস্থ মানুষের সঙ্গে সুস্থ মনের সম্পর্কের মতো অবিচ্ছেদ্য। ‘অ যবধষঃযু ভধসরষু রং ধ ংধপৎবফ ঃবৎৎরঃড়ৎু.’১১২ তেমনি একটি সুস্থ জাতি গঠন করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর এ সুস্থ জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন সুস্থ নেতা।
আপনারা কি অলস এবং অকর্মণ্য কোনো নেতার কথা চিন্তা করতে পারেন, যিনি একটা শক্তিশালী দেশ দিতে পারেন? কখনও সম্ভব নয়। শক্তিশালী জাতি দিতে হলে একজন নেতাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে যোগ্য থাকতে হবে। যোগ্য হতে হলে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই তাঁকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে বুদ্ধির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। অমিত রায়ের ভাষায় : ঊীবৎপরংবং ধৎব ষরশব ঢ়ৎড়ংব, যিবৎবধং ুড়মধ রং ঃযব ঢ়ড়বঃৎু ড়ভ সড়াবসবহঃং.১১৩
ব্যক্তিগতভাবে খেলাধুলা উপভোগ আমার প্রাত্যহিক রুটিনের একটি অংশ। সময় পেলে আমি বিভিন্ন চ্যানেলে খেলাধুলা উপভোগ করি। ছেলেবেলায় গ্রামে থাকাকালীন আমি বিভিন্ন দেশীয় খেলা খেলতাম। আমি নিজেকে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী মনে করি না। তবে আমার স্বাস্থ্য যা আছে, তা ভালো রাখার চেষ্টা করি। অসুস্থ থাকলে আমি চলতে পারব না, কাজকর্ম করতে পারব না।
আপনার বেঁচে থাকাটাই নির্ভর করে, আপনি কতটুকু সুস্থ ও বলবান বোধ করছেন তার ওপর। অর্থ উপার্জনের জন্য স্বাস্থ্যকে বিসর্জন দেওয়ার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না। এটি মুরগির জন্য গরু শিরনি দেওয়ার মতো হাস্যকর একটি ব্যাপার।
মনকে ভালো রাখতে হলে, স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হবে। আমার বাইরে এবং পার্কে হাঁটার শখ, কিন্তু তা আমি নিরাপত্তা ও বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে করতে পারি না। উন্নয়ন আর শান্তির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা অনিবার্য শর্ত। আইনশৃঙ্খলার পর্যাপ্ত উন্নয়নের মাধ্যমে জননিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত না-করা পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাইরে হাঁটতে পারি না বলে আমি বাসার ট্রেড মেইলে প্রতিদিন আধঘণ্টা করে হাঁটি। তবে অনেক সময় কাজের চাপে প্রতিদিন তা-ও করা সম্ভব হয় না। কিন্তু সপ্তাহে ৩/৪ দিনের কম কখনও হয় না। আমার কিছু ভিন্ন ধরনের শখ আছে, যা আমি সাধারণভাবে প্রতিদিন অনুশীলন করি।
সবার জন্যই আমার একটি পরামর্শ- নিজেকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য নিয়মিত হাঁটাচলা করুন। কারণ আপনার শারীরিক যোগ্যতাই নির্ধারণ করে দেবেÑ আপনি কতটুকু অর্জন করতে পারবেন। তাছাড়া আপনার বেঁচে থাকাটাই নির্ভর করে, আপনি কতটুকু সুস্থ ও বলবান বোধ করছেন তার ওপর। অর্থ উপার্জনের জন্য স্বাস্থ্যকে বিসর্জন দেওয়ার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না। এটি মুরগির জন্য গরু শিরনি দেওয়ার মতো হাস্যকর একটি ব্যাপার।
আমার নিজের এবং আপনাদের সবার উদ্দেশে বলছি, কার্ডিওভাস্কুলার সংক্রান্ত ব্যাধি, উচ্চ রক্তচাপ এবং বহুমূত্র রোগসহ অন্যান্য আরও অনেক রোগ শরীরচর্চার অভাবেই হয়। আমরা এ যুগের মানুষ যত অসুখ-বিসুখে ভুগে থাকি, তত অসুখ-বিসুখ ভোগ করত না আমাদের পূর্বপুরুষরা। কারণ তাদের সচল জীবন এবং কাজের ধরন যেমন ছিল, তা শরীরচর্চার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মনে রাখুন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।
যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা তাদের চারপাশের পৃথিবীকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাদের পক্ষে কি সম্ভব অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করা?
যেসব নারী শরীরচর্চা করার জন্য বাইরে হাঁটতে বের হন, তাঁদের দেখে এটা অন্তত ভালো লাগে যে, তাঁরা সংসারের অনেক ঝামেলার মধ্যে নিজেদের জন্য একটু সময় বের করেছেন। এটি শুধু তাঁদের জন্য নয়, পরিবারের জন্যও আবশ্যক। কারণ সুস্থ নারী মানেই সুস্থ পরিবার, আর সুস্থ পরিবার মানে সুস্থ সমাজ এবং সুস্থ সমাজ মানে সুস্থ জাতি। সবচেয়ে বড় কথা নারীরা এখন স্বাস্থ্য-সচেতন। এটি আমাদের পরিবার ও জাতির জন্য একটি কল্যাণকর ইঙ্গিত।
অনেকেই শরীরচর্চা, শারীরিক সুস্থতা এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কথা বলেন না। এটা বলা দরকার। কারণ বেশিরভাগই বলবে, সে চেষ্টা করেও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তাই সে হাঁটাহাঁটি শুরু করেছে। কিন্তু মোট কথা হলো- যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা তাদের চারপাশের পৃথিবীকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাদের পক্ষে কি সম্ভব অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করা?
অনেকেই বলে থাকেন, ব্যস্ততার জন্য বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। আমি অবাক হই, যদি তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তারা তাদের টাকাপয়সা দিয়ে কী করবে? অনেক লোক আছে অর্থ আর সুনামের জন্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং শেষ পর্যন্ত হারানো স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য অর্জিত অর্থ হাসপাতালে ব্যয় করে ফেলে। এমন হতভাগাদের কাছ থেকে সমাজ ভালো কিছু আদায় করতে পারে না। আবার অনেকেই অজুহাত দেখায়, গবেষণা কিংবা পড়াশুনার জন্য শরীরচর্চা করতে পারছে না- তাদের পড়াশুনা আর গবেষণা তাদের যতই কাজে আসুক, কিন্তু স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারবে না। পরিবারের সঙ্গে সুস্বাস্থ্য নিয়ে যে সময় কাটাতে পারে না, তার জীবন তো ষোলো আনাই বৃথা!
যাই হোক, পরিশেষে ছোট্ট একটি পরামর্শ আপনাদের দিতে চাই : জীবনে আর যাই করুন, শরীরচর্চার জন্য কিছু সময় বের করতে হবে আপনাকে, এটিই হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে সুখকর বিনিয়োগ, যা আপনার স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ এবং সুখকে অটুট রাখবে। মনে রাখবেন : অ ংবিবঃ ষরভব রং ধ ংবিধঃু ষরভব.১১৪ সময়ই যদি জীবন হয়, তাহলে স্বাস্থ্যই কেবল আমাদের সেই সময়কে অর্থবহ ও জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। কারণ প্রতিটি সময়কে কাজে লাগালে মানুষের জীবনে প্রতিমুহূর্তে এক-একটি করে সফল কাহিনি লেখা হয়। সময় কাজে লাগাতে না পারলে সাফল্য কখনও ধরা দেবে না।
সুস্থতা শ্রীবৃদ্ধির জনক এবং পরিতৃপ্তির অফুরন্ত উৎস। এটি পুষ্ট প্রকৃতির মতো মনোরম এবং প্রশান্ত বাতাসের মতো সর্ব-উপভোগ্য একটি সকাল, যৌবনের উন্মাদনায় সৃষ্টির তারল্য এবং শেষ বয়সের জন্য অপূর্ব শান্তির প্রতীক। স্বাস্থ্যের মতো সম্পদ এবং সুস্থতার মতো সুখ আর নেই। কেবল নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে এ দুটি অর্জন করতে হয়। সাধারণ সম্পদের চেয়ে এ দুটির মূল্য কোটিগুণ বেশি। একজন যতই ধনশীল হোক না কেন- স্বাস্থ্য বা সুস্থতা না থাকলে তার অন্য সব সম্পদ অর্থহীন হয়ে যায়।
একজন ব্যক্তি যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, শারীরিক অসুস্থতা তার সবকিছু অর্থহীন করে দিতে পারে। আপনি যদি স্বাস্থ্যবান হন, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি সুখী এবং আপনি যদি ভালো অনুভব করেন, তো পৃথিবীর আর কোনোকিছুই প্রয়োজন নেই আপনার। অসুস্থ ব্যক্তি, সে যত বড় সম্পদশালী বা ক্ষমতাবানই হোক না কেন- সে গভীর সমুদ্রের মাঝখানে তলাফুটো জাহাজের মতোই অসহায় অবস্থায় তলিয়ে যেতে থাকে।
[ আগামীকাল পড়–নÑ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : একটি পর্যালোচনা ]