বড়দিন : ভালবাসার মহোৎসব
ড. ব্রাদার হ্যারোল্ড বিজয় রড্রিকস্, সিএসসি
সারাবিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় পর্বদিন হলোÑ বড়দিন। যদিও ২৫ ডিসেম্বর তারিখে দিনটি উদ্যাপন করা হয়, তবে এর ঐতিহাসিক ভিত্তি সম্পর্কে নানা মতামত রয়েছে। তারিখের প্রকৃত ইতিহাসের আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধু দিনটির তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা লিখতে চাই।
বিশ্বের সকল খ্রিস্টানদের জন্য দিনটি অবশ্যই অতীব তাৎপর্যপূর্ণ, তবে তা আজ আর শুধু খ্রিস্টানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও দিনটিকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পালন করেন। এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ হতে পারে যে দিনটি ভালোবাসার একটি মহোৎসবের দিন। ভালোবাসার মহোৎসব এজন্যে যে যার জন্ম উপলক্ষে দিনটি উদ্যাপন করা হয়, তিনি এমনই একজন ব্যক্তি, যিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে, মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক।
মানুষ হলো সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তিনি অত্যন্ত ভালোবেসে তাদের সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে মানুষ ব্যর্থ হয়, কারণ মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে সহজেই ভুলে গিয়ে পাপে পতিত হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা, মানুষের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসার কারণেই, সেই পতিত মানুষকে উদ্ধার করে তার সৃষ্টির মাহাত্ম্যকে পুনর্জীবিত করতে যিশু খ্রিস্টকে এ জগতে প্রেরণ করেন। সেই যিশু খ্রিস্টকে তিনি ঐশী আত্মার বিশেষ শক্তিতে কুমারি মারইয়ামের গর্ভজাত সন্তান করে মানুষের বেশেই মানুষের কাছে পাঠালেন। অন্য কথায়, খ্রিস্টিয় বিশ্বাসে যিশু খ্রিস্ট হলেন ঈশ্বরেরই পুত্র।
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনুসারে ঈশ্বরের অপর নাম ভালোবাসা। ‘…ভালোবাসা ঈশ্বর থেকে উদ্গত এবং যে কেউ ভালোবাসে, সে ঈশ্বর থেকে সঞ্জাত আর ঈশ্বরজ্ঞান লাভ করে। যে ভালোবাসে না, সে ঈশ্বরকে জানল না, কারণ ঈশ্বর ভালোবাসা…’ (১ যোহন ৪ঃ ৭-৮)।
ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে যিশু খ্রিস্টও তাই ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রতিমূর্তি, অর্থাৎ যিশু খ্রিস্ট নিজেই ঐশী ভালোবাসার মানবরূপ। ‘এতেই আমাদের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে; ঈশ্বর তার একমাত্র পুত্রকে জগতে প্রেরণ করেছেন তার দ্বারাই আমরা যেন জীবন পাই। আর এতেই ভালোবাসার অর্থ; আমরা যে ঈশ্বরকে ভালোবেসেছিলাম এমন নয়, কিন্তু তিনি আমাদের ভালোবাসলেন এবং আমাদের পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্য হতে নিজ পুত্রকে প্রেরণ করলেন। প্রিয়জনেরা, ঈশ্বর যখন এমনইভাবে আমাদের ভালোবেসেছেন, তখন আমাদেরও পরস্পরকে ভালোবাসা উচিত’ (১ যোহন ৪ঃ ৯-১০)।
এই মানবরূপী ঈশ্বর যিশু খ্রিস্ট তারই জন্মদিন খ্রিস্টবিশ্বাসীদের নিকট ‘বড়দিন’। এই দিনটিতে খ্রিস্টবিশ্বাসীসহ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষই আনন্দোৎসবে মেতে উঠে। কারণ ভালোবাসা বিষয়টি সর্বজনীন। যেকোনো ধর্মেরই মূলভিত্তি ভালোবাসা; এমনকি যারা কোনো ধর্ম পালন করে না ভালোবাসা তাদের নিকটও পরমপূজ্য। ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষানুসারে: ‘আল্লাহই ভালোবাসা’ (আল-কুরআন ১১ঃ ৯০; ৮৫ঃ ১৪); ‘ভালোবাসা হচ্ছে ভ্রাতৃত্ববোধ’ (আল-কুরআন ৩ঃ ১০৩); ‘ভালোবাসা অপরিবর্তনীয়’ (আল-কুরআন ৩ঃ ১৪৬); ‘ভালোবাসা আন্তরিক’ (আল-কুরআন ৭ঃ ১৮৯)। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র গিতায় বলা হয়, ‘সে যখন সকলের মধ্যে আমাকে দেখে এবং আমার মধ্যে সকলকে দেখে, তাকে আমি কখনো পরিত্যাগ করি না এবং সেও আমাকে পরিত্যাগ করে না। ভালোবাসার এই একাত্মতায় যে অবস্থান করে, সে সবকিছুতেই আমাকে দেখে; সে যেখানেই থাকুক না কেন, সত্যিকারে সে আমাতেই অবস্থান করে।’ গৌতম বুদ্ধের ভালোবাসা সম্পর্কিত একটি উক্তি হলোÑ ‘তুমি যদি সত্যি সত্যিই নিজেকে ভালোবাস, তবে তুমি কোনোদিন অন্যকে দুঃখ দিতে পার না।’ ভালোবাসা সম্পর্কে কলকাতার সাধ্বী তেরেসা (মাদার তেরেসা) বলেন, ‘এ জগতে ভালোবাসা এবং মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষুধা অন্য যেকোনো ক্ষুধার চেয়ে অনেক বেশি বড়।’
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই অতি কাক্সিক্ষত বিষয় ‘ভালোবাসা’। ঈশ্বরের পুত্র যিশু খ্রিস্ট নিজেই সেই ভালোবাসা, আর সেই ভালোবাসার মহোৎসবই বড়দিন, যা আজ সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে। সুতরাং, আসুন এই ভালোবাসা যিশুর জন্মদিন, অর্থাৎ বড়দিনে ভালোবাসায় আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়-মনকে ভরিয়ে দিয়ে ভালোবাসার মহোৎসবকে আরও মহৎ করে তুলি। সকলের জন্য রইল বড়দিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!
লেখক: যুগ্ম-কমিশনার, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিউ)