এক যুদ্ধশিশুর পরিচয় পাওয়ার গল্প
অনির্বাণ বড়ুয়া: নিজের পরিচয় খুঁজতে বাংলাদেশে এসেছেন মনোয়ারা ক্লার্ক। প্রচলিত ভাষায় তিনি একজন যুদ্ধশিশু। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত কোনো এক মায়ের গর্ভে তার জন্ম হয়। তবে মা বা বাবার পরিচয় পাওয়া যায়নি বলেই তাকে এমন পরিচয় বহন করে চলতে হচ্ছে। তার জন্ম হয় যুদ্ধের সময়ে। ‘৭১-এর যুদ্ধ দলিল’ নামক একটি লেখায় এমনটিই ফুটে উঠেছে। লেখাটি সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে। সেই লেখায় মনোয়ারা ক্লার্কের বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। লেখা মোতাবেক, পাকিস্তানি নরপিশাচরা মনোয়ারার মাকে ধর্ষণ করে পেটে বেয়নেট দিয়ে খোঁচা দিয়ে কেবল মাকেই আহত করেননি সেসব খোঁচায় আহত হন গর্ভে থাকা মনোয়ারা নিজেও। পাঠকদের জন্য লেখটি তুলে ধরা হলো, ‘মা বেঁচে আছেন কি নেই, জানেন না তিনি। তবুও মায়ের স্মৃতির খোঁজে তিনি এসেছেন ঢাকায় একাত্তরের যুদ্ধশিশু মনোয়ারা। শরীরের কয়েকটি জায়গায় পরিষ্কার দাগ এখনো ভীষণ স্পষ্ট, জন্মদাগ হিসেবেই এখন বলতে হয় তাকে। জন্মের পর তো আর তার পক্ষে এটা কীসের ক্ষত বোঝা সম্ভব হয়নি; পরে কৈশোরে জানতে পারলেন, দাগের উৎপত্তি পাকিস্তানি সেনাদের বেয়োনেটের খোঁচানি। বেয়োনেটের আঘাত নিয়েই জন্ম তার। পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণের পর, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তার মাকে। খোঁচার দাগে মায়ের গর্ভের শিশুর দেহও কেটে গেছে। কামিজের একপাশটা তুলে দেখালেন ঘাড়ে, পিঠে, বাহুতে বড় বড় ক্ষত। মৃত পড়ে ছিল মা। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসেন যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে থাকা কানাডিয়ান চিকিৎসক হালকে ফেরি। তার স্থান হয় পুরান ঢাকার মাদার তেরেসা হোমে। সেখান থেকে কানাডিয়ান এক দম্পতি ৬ মাস বয়সে তাকে দত্তক সন্তান হিসেবে নিয়ে যান। নাম হয় তার মনোয়ারা ক্লার্ক। একেবারেই বাংলা না জানা মনোয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর দেশে এসেছেন, কেবলমাত্র জন্মসনদ নিতে। এই সনদের জন্য এত আকুলতা তার আরও ৮/১০ বছর আগেও ছিল না। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ফিনল্যান্ডের এক নাগরিককে বিয়ে করার পর যখন তার মেয়ে জন্মাল আর মেয়েটি হলো অটিস্টিক, তারপরই স্বামী বলতে থাকলো- অটিস্টিক বেবির জন্য তুমিই দায়ী। ‘কারণ, আমার পরিবারের পরিচয় আছে। তোমার কোনো পরিচয় নেই-মা নেই, বাবা নেই-তুমি একটা ওয়ার বেবি আর সে কারণেই তোমার বেবিটা অটিস্টিক হয়েছে।’ গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডায়, ভীষণ উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত হাসির মাঝে বিষণœ হয়ে উঠছিলেন মনোয়ারা, আবার দ্রুত সামলে নিচ্ছিলেন। বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মা নেই, বাবা নেই- আমি জানি না তারা কারা বা আমার জন্ম কোথায়, কিন্তু এখন আমি একটা জিনিসই চাই: আমার জন্মসনদ। আমার জন্মসনদের জন্যই আমি বাংলাদেশে এসেছি।’ ‘আই অ্যাম হিয়ার ফর মাই আইডেন্টিটি। আই অ্যাম হিয়ার ফর মাই ফ্যামিলি। বার্থ সার্টিফিকেট উইল মেইক মি মোর কনফিডেন্ট।’ গত ৩০ নভেম্বর ঢাকায় এসেছেন মনোয়ারা ক্লার্ক এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত-ধর্ষণের শিকার নারীদের ছবিগুলো নিজের মোবাইল ফোনে ধরে রেখেছেন। সেসব ছবি মোবাইল থেকে দেখাচ্ছেন আর প্রতিবেদককে বলছেন, ‘দ্যাখো, আমার মা-ও তো এরকম ছিল হয়তো। এসব ফটোগ্রাফ দেখেছি আর কেঁদেছি। তারপর নিজেকে আবার শক্ত করেছি। মা আমার কে ছিল জানি না, কিন্তু বাংলাদেশ তো আমার মা।’
খবর নিয়ে জানা যায়, মনোয়ারা ক্লার্ক ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মসনদ পান।