বিআইবিএম জরিপ নতুন ব্যাংক চান না ব্যাংকাররা
শারমিন আজাদ: ২০১২ সালে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয় নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মাথায় বড় অংকের খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোয়। প্রতি প্রান্তিকেই বাড়ছে খেলাপির এ পরিমাণ। এ অবস্থায় নতুন করে কোনো ব্যাংক অনুমোদন পাক, তা চান না দেশের ব্যাংকাররা। তবে জনগণের মধ্যে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের কার্যক্রমে থাকা ব্যাংকগুলোর শাখা বৃদ্ধির পক্ষে তারা।
চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। জরিপের ফলাফল নিয়ে সম্প্রতি বিআইবিএমের বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের ৯৫ শতাংশ ব্যাংকারই চান না নতুন কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হোক। ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৫৫ শতাংশ। তবে ৯২ শতাংশ গ্রাহক ও ৭৫ শতাংশ ব্যাংকারই চান বর্তমানে কার্যরত ব্যাংকগুলোর নতুন শাখা চালু করা হোক।
ছোট্ট অর্থনীতির বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের ৩৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু ২০১২ সালেই রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পায় নয়টি বেসরকারি ব্যাংক। চলতি বছওে সেনাবাহিনীর জন্য দেয়া ট্রাস্ট ব্যাংকের আদলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে ‘সীমান্ত ব্যাংক’। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি, বিশেষায়িত দুটি, বিদেশি নয়টিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭। এর বাইরে রয়েছে গ্রামীণ, আনসার-ভিডিপি, কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক বিবেচনায় কার্যক্রমে আসা নতুন ব্যাংকগুলো হলো ফারমার্স, ইউনিয়ন, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি গ্লোবাল, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার, মেঘনা, মিডল্যান্ড ও মধুমতি। নতুন এসব ব্যাংকের কোনোটিই ভালো অবস্থানে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন অনুমোদন পাওয়া নয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২২৫ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৩ কোটিতে। অর্থাৎ তিন মাসেই নতুন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, বিআইবিএমের জরিপে একটি বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন হয়েছে। আমাদেও দেশের প্রেক্ষাপটে যেহেতু ৫৭টি ব্যাংক হয়ে গেছে, সেহেতু আর নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে। তবে দেশের ব্যাংকিং খাতে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার শাখাই হয়নি। এজন্য বিদ্যমান চাহিদার আলোকে নতুন শাখা চালু করার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা হলো, কোনো ব্যাংক দুটি শাখা চালু করলে অবশ্যই একটি গ্রামে হতে হবে। এ নীতি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর জন্য কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি হয়। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার মালিক। তবে সরকারের অনুমোদন না পেলে কখনই বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়নি।
ছোট পরিসরে পরিচালিত বিআইবিএমের জরিপে দেখা যায়, দেশের ৭৫ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা চান বর্তমানে কার্যরত ব্যাংকগুলো নতুন নতুন শাখা চালু করুক। ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে নতুন শাখা চালু করার পক্ষে মত দিয়েছেন ৯২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর নতুন শাখা চালুর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন ৮৮ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহক। অন্যদিকে দেশে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৯৫ শতাংশ ব্যাংকার। ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ মনে করেন, দেশে এখনো নতুন ব্যাংক চালু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মনে করেন, দেশে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো দরকার নেই। সব মিলিয়ে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৬৪ শতাংশ ব্যাংকার ও গ্রাহক।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, আমাদেও দেশে ব্যাংক চালু করার সুবিন্যস্ত পদ্ধতি রয়েছে; কিন্তু ব্যাংক বিলুপ্তি কিংবা একীভূত করার ভালো কোনো প্রক্রিয়া নেই। ব্যাংক জন্ম দেয়ার জন্য কী কী লাগবে সেটি বলা থাকলেও, সেই ব্যাংকটি টিকে থাকতে হলে কী কী করতে হবে সেটি বলা থাকবে না, এটি হতে পারে না। আইন ও নীতিগত কাঠামোর অভাবেই নতুন ব্যাংকের সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক বিলুপ্তি নীতিমালার দাবি করে আসছি।
তিনি বলেন, বিলুপ্তির নীতিমালা থাকলে বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকের জন্ম হবে, অন্যদিকে বাজাওে কোনো ব্যাংকের উপযোগিতা না থাকলে বিলুপ্ত হবে। এটিই হওয়া উচিত। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৫০টি হবে, নাকি ২০টিতে নেমে আসবে, সেটি নির্ভর করবে মার্কেট ইকোনোমির ওপর। আমেরিকায় প্রতিবছরই ১০০ থেকে ১৫০টি ব্যাংকের জন্ম হচ্ছে, আবার ১০০ থেকে ১৫০টি ব্যাংক বিলুপ্ত হচ্ছে। বাজারে টিকে থাকার সক্ষমতা থাকলে ব্যাংক টিকবে অন্যথায় বিলুপ্ত হবে, এটিই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি বা কম, এটি অর্থনীতির আকার বা জনসংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উচ্চ সতর্কতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পুরো ব্যাংকিং খাত তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি দেশের ভালো বাজার, গ্রাহক, প্রতিযোগী ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ঋণ বিতরণের জন্য দেশে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। কার্যরত ব্যাংকগুলোয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা কোনোভাবেই বাধার সম্মুখীন হন না। দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান। ফলে কার্যরত ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করতে পারছে না। ব্যাংকের নতুন শাখাই নতুন ব্যাংকের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। গ্রাহকরা ঋণের জন্য আবেদন করেই পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছেন। গ্রাহকরা সাধারণভাবে বিদ্যমান ব্যাংকিং সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট। বিদ্যমান কিছু ব্যাংক টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এসব কারণে দেশের ব্যাংকাররা নতুন কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হোক এটি চান না। সম্পাদনা : জি আর পারভেজ