উৎসব ছোঁয়নি সাঁওতালদের বড়দিন শুধু আনুষ্ঠানিকতায়
ডেস্ক রিপোর্ট: উচ্ছেদের আগুনে পুড়ে যাওয়া গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের এবার ছুঁতে পারেনি উৎসবের রঙিন আলো; চাপা আতঙ্ক নিয়ে শুধুই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় এবারের বড়দিন উদযাপন করলেন তারা।
এবার বড় দিনে গাইবান্ধার রংপুর চিনিকলের ইক্ষু খামারের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের ঘরে ভালো খাবার ছিল না। পরনে নতুন কাপড় বা গান-বাজনাও ছিল না। বছরের একটি মাত্র উৎসবের দিন তাদের কেটে গেল সাদমাটাভাবে শুধু প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। তাছাড়া ছিল না কোনো আয়োজনও। রোববার সকাল ৯টা থেকে মাদারপুর গির্জার পাশে প্যান্ডেলে পাপমুক্তি, মঙ্গল ও করুণা কামনায় শুরু হয় প্রার্থনা। সাঁওতালপল্লীর নারী-পুরুষ ও শিশুরা অংশ নেয় সেখানে। শুরুতেই মঙ্গলবাণী পাঠের মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধি এবং জগতের সব মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। প্রার্থনা পরিচালনা করেন বিশপ ফাদার সেবাস্টিয়ান টুডু।
জয়পুরপাড়া গ্রামের অলিভিয়া হেমভ্রম বলেন, প্রতিবছর বড়দিনটাকে আনন্দ আর উৎসবে পালন করতেন তারা। পাড়ায় পাড়ায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ছেলে-মেয়েরা সারাদিন এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিত। উচ্ছেদের সেই আগুন জীবনের সব কিছু পুড়িয়ে ফেলেছে।
মাদারপুর গ্রামের সাঁওতালদের প্রতিবেশী রুনা বেগম বলেন, সাঁওতালপল্লীতে বড়দিন আসত মহোৎসবের রূপ নিয়ে। বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই গির্জা সংস্কার, ঘর সাজানো, বাড়িঘর নিকানো, রঙের প্রলেপ দেওয়া, আঙিনায় আলপনা আঁকা হতো। শিশুরাও থাকত সান্তা ক্লজের অপেক্ষায়। দিনভর গান-বাজনা, পানাহার, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে মেতে উঠত সবাই। কিন্তু এবার সাঁওতালপাড়ায় চিরাচরিত সেই আয়োজন চোখে পড়েনি।
আদিবাসী নেতা পাওলুস মুরমু বললেন, আদমপুর মিশন আর মাদারপুর গির্জা ছাড়াও আশপাশের পাড়াগুলোয় স্থাপিত ক্যাথলিক আর লুথেরানদের কিছু গির্জায় এবার বড়দিনে নিজেদের কল্যাণ ছাড়াও ভূমি অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
মাদারপুর গ্রামের বার্নাবাস টুডু বলেন, ভূমির অধিকার নিয়ে আর কোনো আন্দোলন এবং উচ্ছেদেরে বিষয়ে মুখ না খোলার জন্য সাঁওতালদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে উচ্ছেদ অভিযানের পর ওই দুটো পল্লীসহ খোলা জায়গায় আশ্রয় নেওয়া সাঁওতালরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন যাপন করছে। এই নিরাপত্তাহীনতা আর অভাবে দিনাতিপাত করায় শুধু প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে এবার বড়দিন উদযাপন হয়েছে। আদিবাসী নেতা রাফায়েল হাসদা বলেন, বড়দিনে পল্লীতে বাইরের দুর্বৃত্তরা এসে যাতে কোনো ঝামেলা করতে না পারে সেজন্য স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছিল। হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করে সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে এটি একটি পক্ষের ষড়যন্ত্র। ওই পক্ষটি কিছু কিছু সাঁওতালকে দিয়ে এসব আজগুবি কথা বলাচ্ছে।
মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতালপল্লীতে বড়দিনের উৎসব যাতে নির্বিঘেœ হয় সেজন্য পুলিশের নজরদারি ছিল বলে জানিয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা বিরোধপূর্ণ জমি থেকে ঘর তুলে বসবাস করা সাঁওতালদের গত ৬ নভেম্বর উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় সংঘর্ষ বাঁধে এবং সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের ওই ঘটনায় সমালোচনা হয় দেশজুড়ে। সাঁওতালদের বসতি উচ্ছেদের পর প্রায় ৩০০ পরিবার মাদারপুর মিশন গির্জা ও মিশনারি স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনের মাঠে এবং জয়পুরপাড়া গ্রামের খোলা জায়গায় তাঁবুতে বসবাস করছে। সম্পাদনা: হাসিবুল ফারুক চৌধুরী