যিশুর জন্ম মুহূর্তের সেই ‘তারা’ আসলে তারা নয় !
ডেস্ক রিপোর্ট: বেথলেহেমের আকাশে সেদিন সেই ‘তারা’টি ছিল না! কোনো ‘এক তারার সুরে সেদিন ‘একতারা’ বাজেনি বেথলেহেমে। ‘তারা’ চিনতে বোধহয় কিছুটা ভুলই করে ফেলেছিলেন তারা। সেই তারা হলেন, উটের পিঠে সওয়ার সেই তিনজন। বাইবেলে যাদের ‘ওয়াইজ ম্যান’ (জ্ঞানী) বা ‘কিং’ (রাজা) বলা হয়েছে। যাদের অন্য নাম- ‘মেজাই’।
খ্রিস্টের জন্মের আগে ষষ্ঠ শতকে (সিক্সথ্ বিসি বা বিফোর ক্রাইস্ট) যে ‘তারা’টির অভূতপূর্ব আলোক-বিচ্ছুরণে তিন ‘মেজাই’ সেদিন রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তা কোনো ‘বিশেষ তারা’ ছিল না। ছিল না নতুন কোনো নক্ষত্র। আদতে তা ছিল সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীকে নিয়ে ৬টি গ্রহ আর একটি উপগ্রহের (চাঁদ) এক অত্যাশ্চর্য যুগলবন্দি! যার সঙ্গে তাল মিলিয়েছিল একটি নক্ষত্রপুঞ্জের (কনস্টেলেশন) একটি অবাক করা অবস্থান। যা চট করে হয় না। অন্তত কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে তো হয়ই না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্স’। ‘তারা’ চিনতে ভুল হলেও, বেথলেহেমের আকাশে সেদিন ওই তেজোময় আলোক-রশ্মির বিচ্ছুরণ ছিল একটি ‘মাহেন্দ্র-ক্ষণ’। একেবারে ঠিকঠাকভাবে সেটা বুঝতে কিন্তু কোনো অসুবিধা হয়নি ব্যাবিলন বা মেসোপটেমিয়ার তিন ‘মেজাই’য়ের। আমেরিকার নোটরডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ সায়েন্সের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের থিয়োরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ও কসমোলজির অধ্যাপক গ্র্যান্ট ম্যাথিউজের গবেষণা এমনটাই দাবি করেছে। ১ ডিসেম্বর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর বাইবেলের যাবতীয় তত্ত্ব ও তার ব্যাখ্যা ঘেঁটেঘুঁটে ম্যাথিউজ তার সদ্য প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন। আনন্দবাজারের তরফে ই-মেইলে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল অধ্যাপক গ্র্যান্ট ম্যাথিউজকে। ব্যাবিলনের আকাশে ওই ‘অলৌকিক তারা’টিকে কবে দেখতে পেয়েছিলেন ব্যাবিলনের তিন ‘মেজাই’?
ওয়াশিংটন থেকে তার ই-মেইল জবাবে ম্যাথিউজ লিখেছেন, সেই ঘটনাটি ঘটেছিল খ্রিস্টের জন্মের আগে ষষ্ঠ শতকে। সেই তারিখটা ছিল ১৭ এপ্রিল। আর সেটাই ছিল ‘মেজাই’দের বলা সেই ‘মাহেন্দ্র-ক্ষণ’। যা দেখে তারা কোনো ‘তারকা যুগপুরুষে’র আগমন-বার্তার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
কেন ওই সময়টিকে বলা হচ্ছে ‘মাহেন্দ্র-ক্ষণ’?
ম্যাথিউজের ই-মেইল জবাব, সূর্য আর পৃথিবীসহ ৬টি গ্রহ (বৃহস্পতি, শনি, মঙ্গল, বুধ, শুক্র) আর উপগ্রহের (চাঁদ) অনেকটা একই রকমের ওই অত্যাশ্চর্য অবস্থান আজ থেকে ১৬ হাজার বছরের আগে আর হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ১৬ হাজার বছর পরেও সূর্যের সঙ্গে ওই গ্রহগুলোর অবস্থান একেবারে অবিকল হবে না খ্রিস্টের জন্মের আগেকার ষষ্ঠ শতকের ১৭ এপ্রিল দিনটির মতো। আর সেই সময় সূর্য আর ওই গ্রহগুলোর সঙ্গে যে অবস্থানে ছিল ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্স’, একেবারে সেই অবস্থান আগামী পাঁচ লক্ষ বছরের আগে আর কোনো দিনই হওয়া সম্ভব নয়। বিস্তর অঙ্ক কষে তার গবেষণাপত্রে সেই হিসেবটাই দেখিয়েছেন অধ্যাপক ম্যাথিউজ। আনন্দবাজারের পাঠকদের জন্য তার একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও-ও পাঠিয়েছেন অধ্যাপক ম্যাথিউজ। গত এক দশকের গবেষণার ফলাফলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন তার সাক্ষাৎকারের। যাকে ‘তারা’ ভেবেছিলেন সেদিন
ব্যাবিলনের তিন ‘মেজাই’, তা আদতে কী ছিল?
আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে আমেরিকার আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লুনার অবজারভেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিষ্ণু রেড্ডি ই-মেইলে লিখেছেন, ‘‘সে দিন (খ্রিস্টের জন্মের আগে ষষ্ঠ শতকের ১৭ এপ্রিল) জেরুজালেম আর বেথলেহেমের আকাশে সূর্য আর তিনটি গ্রহ- বৃহস্পতি, শনি, পৃথিবী আর তার উপগ্রহ চাঁদ একেবারে লাইন বেঁধে ছিল এমন একটি অবস্থানে, যাকে বহু দূর থেকে দেখলে মনে হবে, একটি সরলরেখা। তার চেয়েও বড় কথা সূর্য, তার তিনটি গ্রহ বৃহস্পতি, শনি, পৃথিবী আর তার চাঁদ, এই ‘পঞ্চপান্ডব’ই ছিল এক নক্ষত্রপুঞ্জ বা কনস্টেলেশনে। সেই নক্ষত্রপুঞ্জের নাম- ‘অ্যারিস’। আর যেটা আরও অবাক করার মতো ঘটনা, সেটা হল- সেই সময় এই সৌরম-লের আরও একটি গ্রহ শুক্র (ভেনাস) ছিল ঠিক তার পাশের নক্ষত্রপুঞ্জ- ‘পিসেস’-এ। ফলে, অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেই সময় বেথলেহেম, জেরুজালেমের আকাশের ওই অংশটি। যাকে একটি অত্যুজ্জ্বল তারা বলে বিভ্রম হয়েছিল ‘মেজাই’দের। চমকের আরও বাকি রয়েছে। কারণ, ওই একই সময়ে উল্টো দিকের নক্ষত্রপুঞ্জ- ‘টরাস’-এ ছিল এই সৌরম-লের আরও দু’টি গ্রহ বুধ (মারকারি) ও মঙ্গল (মার্স)। এখানেও চমকটা শেষ হয়নি। সেই সময় গোটা ‘অ্যারিস’ নক্ষত্রপুঞ্জটাই ছিল ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্সে’। আগামী পাঁচ লক্ষ বছরেও যে অবস্থানে পৌঁছানো কখনই সম্ভব নয় ‘অ্যারিস’ নক্ষত্রপুঞ্জের পক্ষে।’’
কেন সেদিন অতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তিন ‘মেজাই’য়ের দেখা ‘তারা’টি?
ম্যাথিউজ তাঁর ই-মেইল জবাবে লিখেছেন, ‘‘তার মূল কারণ, বৃহস্পতির মতো এই সৌরম-লের সবচেয়ে বড় গ্রহটির ‘রেট্রোগ্রেড মোশন’। সূর্যকে পাক মেরে পৃথিবীর মতোই ঘোরে অন্যান্য গ্রহগুলো। তবে এক এক গ্রহ সূর্যকে পাক মারতে এক এক রকম সময় নেয়। আর সেই আবর্তনের সময়ই আকাশে গ্রহগুলোকে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে সরে যেতে দেখা যায়। কিন্তু ওই যাওয়ার পথেই কখনও কখনও ওই গ্রহগুলো পিছু হটে আসে কিছুটা। পূর্ব দিক থেকে সরে আসে পশ্চিম দিকে। এটাকেই গ্রহগুলোর ‘রেট্রোগ্রেড মোশন’ বলে। পিছু হটে আসার কিছু দিন বা মাস পরেই ওই গ্রহগুলোকে আবার সামনের দিকে বা পূর্ব দিকের আকাশে সরে যেতে দেখা যায়। এটা হয় পৃথিবী নিজেও ঘুরছে আর সূর্যকে পাক মারছে বলে। ঠিক যেমন একটা চলন্ত গাড়ি থেকে একই দিকে ছুটে চলা অন্য গাড়িটিকে দেখলে মনে হয়, সেই গাড়িটি পিছিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনটাই। এটা আসলে দৃষ্টির বিভ্রম। যা ঘটে গতিবেগের আপেক্ষিকতার কারণে। বৃহস্পতির এই ‘রেট্রোগ্রেড মোশন’ স্থায়ী হয় ঠিক চার মাস। তার ন’মাস পর আবার হয় বৃহস্পতির ‘রেট্রোগ্রেড মোশন’।’’
এবার একটু বুঝে নেওয়া যাক, ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্স’ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুনন্দ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পৃথিবীর বিষূবরেখা (ইক্যুয়েটর) থেকে সূর্যের ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া একটি সরলরেখা কল্পনা করলে সেই রেখাটির ওপর যে তলটি (প্লেন) দাঁড়িয়ে থাকে, তাকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্স’। উত্তর গোলার্ধ বা নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ারে ওই ‘ভার্নাল ইক্যুইনক্স’টি তৈরি হয় ফি-বছর ২০ মার্চ থেকে। ওই দিনটি থেকেই উত্তর গোলার্ধে শুরু হয়ে যায় বসন্ত কাল (স্প্রিং)। ওই সময় পৃথিবীর বিষূবরেখার ঠিক ওপরে থাকে সূর্য।’’ আনন্দবাজার। সম্পাদনা : শাহানুজ্জামান টিটু