ফরিদ জাকারিয়ার বিশ্লেষণ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বদলে দিলেন ওবামা
পরাগ মাঝি: যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের জীবন শুরু হয়েছিলো গৃহপালিত পশুর মতো।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের ধরে ধরে জাহাজ ভরে নিয়ে আসা হতো। তারপর গৃহস্থালি থেকে শুরু করে ফসলের মাঠে কাজ করানোর জন্য সাদা চামড়ার প্রভুরা তাদের কিনে নিতো, আর সাধারণ চুন থেকে পান খসলেই তাদের উপরে চলতো নির্মম নির্যাতন। প্রায় আড়াইশ বছরের দাসত্বের পর ১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এর ঠিক একশ বছর পর কালোদের নায়ক মার্টিন লুথার কিংয়ের মুখ থেকে ধ্বনিত হয় তার অবিস্মরণীয় ভাষণ- ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে।’ ঠিক এসময়ও কি কেউ ভেবেছিলো- মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই এই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন এক কালো মানুষ। ২০০৮ সালে এমন অসম্ভব ভাবনার বাস্তব রূপ নিয়েছিলো যার হাত ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বলা যায়, তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তার দায়িত্বকে সমাপ্ত করতে চাননি বরং বিশাল এই দেশটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে তিনি ছিলেন নিঃশঙ্ক চিত্ত।
সিএনএন’র হোস্ট ফরিদ জাকারিয়া সম্প্রতি ওবামা প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। শুরুতেই তিনি ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। সেখানে বলা হয়েছিলো, প্রেসিডেন্সির শুরুর দিকে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের নিয়ে কাজ করা প্রতিথযশা ঐতিহাসিকদের হোয়াইট হাউসে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানাই ছিলো তার উদ্দেশ্য। এর নেপথ্যে ছিলো মূলত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন ধারণার অনুসন্ধান। ‘টাইম’ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, আলোচনা যতোই এগিয়ে যাচ্ছিলো, অনেকেই বুঝতে পারছিলেন পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মধ্য থেকে ওবামা যার প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ পাচ্ছিলেন তিনি হলেন রোনাল্ড রিগ্যান।
রিগ্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে একটু ব্যাতিক্রম। ঘোর রক্ষণশীল এই মানুষটি অভিনেতা থেকে রাজনীতিতে পদার্পন করেন। বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং বুদ্ধিজীবীতার চেয়েও তিনি ভীষণ গপ্পোবাজ এবং কৌতুকরসে পরিপূর্ণ এক মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওবামা দেখেন, অন্য প্রেসিডেন্টদের চেয়ে রিগ্যানই বেশি রূপান্তরকামী ছিলেন। যেমনটা ছিলেন না রিচার্ড নিক্সন থেকে শুরু করে বিল ক্লিনটনের কেউই। তবে, ওবামা এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তার ভাবনায় ছিলো তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কক্ষপথকে পরিবর্তন করে একে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। তিনি কি সেটা পেরেছেন?
ফরিদ জাকারিয়া তার বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, ওবামার প্রশাসন যুগান্তকারী সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিল পাস করিয়েছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎস তৈরিতে তার প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি পলিসির মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বিশ্বমন্দার সময় ওবামা প্রশাসন আর্থিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্তম পুনর্গঠন প্রণয়ন করেন। ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর তার মেয়াদের প্রথম ১৮ মাসের মধ্যেই অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত তিনি নেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম দু’বছরেই বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি তার প্রজ্ঞার ব্যবহার করে বিতর্ক করেছেন। দেশিয় নীতিতে তিনি যত ইতিবাচক পরিবর্তন করেছেন প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসনের পর এমনটি আর কেউ করতে পারেননি।
তবে হ্যাঁ, ওবামার সব নীতিই এখন বিপদের মুখে। নবনির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিম ইতোমধ্যেই এসব নীতি বাতিল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা হয়তো কয়েকটি নীতি খুব সহজেই বাতিল করে দিতে পারবে। তবে, কিছু নীতি বদলে দেওয়াটা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মোটেও সহজ হবে না। এদের মধ্যে রয়েছে, ওবামা কেয়ার; প্রায় ২২ মিলিয়ন লোক এই সেবার সঙ্গে সংযুক্ত। তারপর আছে পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎস প্রকল্প; যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত এবং কয়েক মিলিয়ন চাকরিও এর উপর নির্ভরশীল।
শক্তিশালী উত্তরাধিকার সৃষ্টিতে ওবামার সাফল্য ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে ফরিদ জাকারিয়া তার বিশ্লেষণে জনসন এবং রুজভেল্টের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এ দুজন শক্তিশালী উত্তরাধিকার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ, কংগ্রেসে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। বারাক ওবামা একজন দুর্দান্ত ক্যারিশমাটিক নেতা হলেও তার কিছু ব্যর্থতার হিসেব আছে। কারণ, ওবামা তার উত্তরসূরী রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার আমলে ডেমোক্রেটরা স্থানীয় এবং জাতীয় অবস্থানগুলোতে শক্তি হারিয়েছে। বলা যায়, ১৯২০ সালের পর এই দলের এমন দুর্দশা আর হয়নি।
এসব দিক বিবেচনায় এটা কি বলা যায় যে, ওবামা ব্যর্থ? অন্য যে কোনো প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি পরিমাণে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও ওবামাকে ব্যর্থই বলা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, প্রযুক্তি, রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতিতে নানা পরিবর্তন সম্পন্ন হয়েছে। ইতিহাসবেত্তাদের সঙ্গে ডিনারে রোনাল্ড রিগ্যান সম্পর্কে ওবামা বলেছিলেন, ‘তিনি একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ দেশ এর জন্য প্রস্তুত ছিলো।’ এখন প্রশ্ন হলো- ওবামা যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো ঘটাতে চেয়েছেন সেগুলোর জন্য আমেরিকানরা কি প্রস্তুত ছিলো। তবে, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে যে মৌলিক ভিত্তি ওবামা তৈরি করেছেন তা অন্তত সাতজন প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করেও সফল হননি।
ফরিদ জনএফ কেনেডির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি হোয়াইট হাউসে শক্তি, প্রাণপ্রাচুর্য, কোমলতা এবং প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। তবে, হোয়াইট হাউসে ওবামা যে ছাপ রেখে গেছেন তা অমোচনীয়। বলা যায়, ওবামা ও তার পরিবার হোয়াইট হাউসে মর্যাদা, ক্ষমাশীলতা এবং সুস্থ মানসিকতার একটি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তিনি এমন একটি প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যা সর্বোপরি কলঙ্ক (স্ক্যান্ডাল) মুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বকে কি দারুণ ছন্দে তিনি উদযাপন এবং উপস্থাপন করেছেন যে কোনো পরিমন্ডলে। এটা তিনি করেছেন একেবারে ফোকাসের কেন্দ্রে থেকেও, কারণ তিনি দেখতেই ভিন্ন, অসাধারণ। বলা যায়, প্রথম আফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমেরিকানরা ওবামাতেই বাজি ধরেছিলো। ব্যক্তিগত চরিত্র এবং প্রজ্ঞা দিয়ে ওবামা এর যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। সূত্র : সিএনএন। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম