নারী জঙ্গিদের সমন্বয়ক শারমিন পালাতে ব্যর্থ হলে আত্মাহুতির নির্দেশ
বিপ্লব বিশ্বাস ও সুজন কৈরী: জঙ্গিদের নারী শাখার সিদ্ধান্তগুলো অনেক গোপনীয়। জঙ্গিরা তাদের স্ত্রীদের দীক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘জিহাদের’ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোনোভাবেই পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। লড়াই করে ধরা পড়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজনে আত্মাহুতি দিতে হবে। নিজেদের আত্মরক্ষায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের জঙ্গি দীক্ষা দেওয়া এবং সংগঠনে নতুন ‘সিস্টার’ (বোন) বাড়ানোরও নির্দেশনা রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি দমনে যুক্ত পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতাদের স্ত্রী ও নারী স্বজনদেরও জঙ্গিবাদে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি সংগঠনের কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ নব্য জেএমবি তাদের আদলে চলার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যের ওই সংগঠনটি ঘোষণা দিয়েই নারীদের দলে ভিড়িয়ে তা ‘যৌন জিহাদ’ নাম দিয়েছিল। এ জন্য তারা অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী জঙ্গিদের সংগ্রহ করতো। সে আদলেই নব্য জেএমবি তাদের সংগঠন পরিচালনার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে শেকড় ভেঙে দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আজিমপুর থেকে গ্রেফতার তিন নারী জঙ্গি গত ১৭ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে বলেছে, স্বামীদের মাধ্যমেই তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। তাদের নির্দেশেই প্রশিক্ষণ নেওয়া থেকে শুরু করে হিযরতের মাধ্যমে নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র (আজিমপুরের আস্তানায়) উঠেছিলেন। তাদের কাছে আরও নির্দেশনা ছিল, সংগঠনের কাজে স্বামীরা মারা গেলেও তারা যাতে সংগঠনের সদস্যদের তৈরি করা নতুন কোনো আস্তানায় চলে যায়। প্রয়োজনে সংগঠনের সদস্যকে বিয়ে করেও ‘জিহাদ’ চালিয়ে যেতে হবে। সংগঠনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ওই তিন নারী জঙ্গি জানিয়েছে, তাদের অন্যতম সমন্বয়ক নব্য জেএমবির প্রশিক্ষণ কমা-ার নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নেসা শিলা। রূপনগরের আস্তানায় শিলার স্বামী নিহত হওয়ার পর সে আজিমপুরে তাদের কাছে আশ্রয় নেয়। তবে পুলিশের অভিযানের আগেই শিলা আজিমপুরের আস্তানা ছেড়ে চলে যায়। সর্বশেষ গত শনিবার শিলা আশকোনার অভিযানে সন্তানসহ আত্মসমর্পণ করেন।
পুলিশের জঙ্গি ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমন বিভাগ-কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নিজেদের জঙ্গি স্বামীর মাধ্যমেই নারীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। তারা স্বামীর নির্দেশেই নিজেদের শিশু সন্তানদের জঙ্গিবাদের দীক্ষা দেয়। এমনকি কথিত জিহাদের প্রয়োজনে তাদের স্বামীরা নিহত হলেও তারা যাতে লক্ষ্যপূরণে সংগঠনের অন্য কাউকে বিয়ে করে নারী জঙ্গিদের কাছে সে নির্দেশনাও আছে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ফার্মগেট ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে নারী জঙ্গি মারজিয়া আক্তার ওরফে সুমি, তার স্বামী শরিফুল ইসলাম, নাহিদা সুলতানা ও তার স্বামী আমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও নারী জঙ্গিদের কার্যক্রম সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
জঙ্গি মারজিয়া ওই সময় জানিয়েছিল, সে ফেসবুকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে সংযুক্ত হয়। পরে অন্তর্ভুক্ত হয় জেএমবির থ্রিমা ও টেলিগ্রাম অ্যাপের বিশেষ দলে। পরে তাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য, আহত শিশুদের ছবি, মেয়েদের ছবি, অসহায় মানুষের ছবি, কিছু হাদিস, যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ও খিলাফত সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে দীক্ষা দেওয়া হয়। এরপর তিনি গত ২০ আগস্ট ‘জিহাদে’র জন্য বাড়ি ছাড়েন। পরে তিনি সংগঠনের সিদ্ধান্তে শরীফুলকে গাজীপুরের সাইবোর্ড এলাকায় গিয়ে বিয়ে করেন। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদ সুলতানা জানায়, সে নারায়ণগঞ্জের সরকারি তুলারাম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। তারপরও শুধু উগ্রপন্থি আদর্শে বিশ^াসী হওয়ায় ও সংগঠনের সিদ্ধান্তে এইচএসসি পাস ও বিবাহিত এবং দুই সন্তানের বাবা আমিনুলকে গত ২২ মে টঙ্গী এলাকায় একটি আস্তানায় বিয়ে করে। তাদের বিয়ের সাক্ষী ছিল মাদারীপুরে শিক্ষক হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) ফাইজুল্লাহ ফাহিম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় এখন পর্যন্ত চারটি পরিবারের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জাহিদুল ইসলাম, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাসারুজ্জামান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজানের পরিবার রয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে এই পরিবারগুলোর কোনো কোনো সদস্য নিহত হয়েছে, কেউ আত্মঘাতী হয়ে মারা গেছে। আবার কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলেছে, নব্য জেএমবির আইটি বিশেষজ্ঞ পলাতক বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেট একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিল ইডেন মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী ফেরদৌসী আফরিন ওরফে শারমিনকে। এরপর দুজনই জড়িয়েছে জঙ্গিবাদে। ১০ মাস বয়সী মেয়ে সাবিহা জামানকে নিয়ে এ দম্পতি মাসের পর মাস চালিয়েছে জঙ্গি কার্যক্রম। তবে শারমিনকে ধরা গেলেও পুলিশ বলছে, এখনো পলাতক বাসারুজ্জামান। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে শারমিন পুলিশকে গুলি করে পালানোর চেষ্টা করে। তবে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছিল। তার ১০ মাস বয়সী মেয়ে নানার জিম্মায় রয়েছে। বাসারুজ্জামানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে শারমিনই নারী জঙ্গিদের সমন্বয়ক বলে জানা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজান কিশোর বয়সে ছিল লাজুক স্বভাবের। ছাত্র অবস্থাতেই প্রেম করে বিয়ে করে খালাতো বোন আফরিন ওরফে প্রিয়তিকে। পরিবারের চোখে মারজান ও প্রিয়তি শান্ত স্বভাবের হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে এ দুজন ভয়ঙ্কর জঙ্গি। মেজর জাহিদুল ইসলাম সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে জড়িয়েছিল নৃশংস জঙ্গিবাদে। হয়েছিল নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষকও ছিল সে। শুধু তাই নয়, জাহিদ নিজের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাকেও দীক্ষা দিয়েছে জঙ্গিবাদে। সুখের সংসার ছেড়ে এ দম্পতি হেঁটেছে জঙ্গিবাদের অন্ধকার গলিতে। অবশ্য গত ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত হয় জাহিদুল ইসলাম, সে নব্য জেএমবিতে মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে ওমর নামে পরিচিত ছিল। এতদিন বিভিন্ন জঙ্গি ডেরায় পালিয়ে বেড়ালেও গত শনিবার আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে মা ও ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশের হাতে সন্তানসহ গ্রেফতার হয় জেবুন্নাহার শিলা। সম্পাদনা: এনামুল হক