গার্ডিয়ানে ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলীর অভিজ্ঞতালব্ধ নিবন্ধ ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের আর্তি বিশ্ব এড়াতে পারে না’
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী নিজের সরেজমিন অভিজ্ঞতায় মিয়ানমারের নিষ্পেষিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের আর্তিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। গত ২৩ ডিসেম্বর লন্ডনের বিশ্বখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘রোহিঙ্গা মুসলিমস ইন মিয়ানমার আর সাফারিং; দ্য ওয়ার্ল্ড মাস্ট নট লুক অ্যাওয়ে’ শিরোনামে হৃদয়স্পর্শী একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পূর্ণ মানবিক সাহায্যের প্রবেশাধিকারে চাপ সৃষ্টিতে দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসনের কাছে ৭০ জন ব্রিটিশ এমপি আবেদন জানিয়েছেন। তারা এখন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে লেখিকার ভাষ্যটি হচ্ছে- বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক কমিউনিটির উচিত রোহিঙ্গাদের আর্তি শোনা ও কথিত নিষ্পেষণের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা, যাতে বর্বরোচিত অত্যাচারের পরিসমাপ্তিটি ঘটে। কেননা মিয়ানমারের সংখ্যালঘুরা শান্তিতে বসবাসের উপযুক্ত।
ওই নিবন্ধের সূচনায় রুশনারা আলী ২০১৪ সালে স্যাটালাইট থেকে তোলা ছবির সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে তোলা ছবির তারতম্য টেনে দেখিয়েছেন কী করে শতাধিক বাড়িঘর পোড়া মাটির সঙ্গে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সরবরাহকৃত ছবিতে এভাবে তিনটি গ্রামের প্রায় ৪৩০টি বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সকরুণ চিত্রটি ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে বিবিসি পরিবেশিত একটি খবরের সূত্রে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার কর্মকর্তা জন ম্যাককিসিকের ভাষায় ‘রোহিঙ্গা নিধনে’র চিত্রটিও স্থান পেয়েছে।
এতে আল জাজিরার সংবাদের ভিত্তিতে বলা হয়েছে-৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মংডুতে নয়জন সীমান্ত রক্ষীর হত্যায় সংখ্যালঘু মুসলিমরা সহসাই আক্রমণের লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সূত্রে গত দুই মাসে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সামরিক শাসিত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ‘শত শত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে’।
ইতিমধ্যে মানবাধিকার গ্রুপগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে ‘হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ’, ‘বিনাবিচারে গ্রেফতার’ এবং ‘নারী ও বালিকা ধর্ষণ’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। জাতিসংঘ ওই ফিরিস্তিতে নির্যাতন, মৃত্যুদ- ও মসজিদ ধ্বংস তালিকাবদ্ধ করেছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে আনুমানিক ১০ লাখ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর রোহিঙ্গা মুসলিমের বসবাস। অথচ সুদীর্ঘকাল ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী এ সকল রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১২ সালে সংঘটিত লাগাতার দাঙ্গায় এদের ১ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়। আমি পরের বছর রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল ও যুক্তরাজ্যের বার্মা ক্যাম্পেইনের সঙ্গে মিয়ানমার সফরে গিয়েছি। সে সময় রোহিঙ্গা কমিউনিটি কী করে নৃশংস আক্রমণে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গেছে তার বর্ণনা শুনেছি। রাখাইন রাজ্যের যে সকল ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবনরক্ষাকারী মানবিক সাহায্য ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছা বন্ধ করা হয়েছে।
আমি নৌকায় জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থার সাহায্যপুষ্ট পোকটো’র ক্যাম্পে গিয়ে চতুষ্পার্শে¦র নোংরা পানিতে মরা ইঁদুর ভাসতে দেখেছি, যেখানে কয়েক মিটার দূরেই গ্রীষ্মের তাপদাহে শিশুরা গোসল করছে। আরও দেখেছি প্রতিনিয়ত বৈষম্যতার শিকার ভীত মুখগুলো। শুনেছি তাদের প্রিয়জন হারানোর মর্মব্যথা, শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া এবং প্রসূতিকালে নারীদের মরে যাওয়ার কথা।
যুক্তরাজ্যের বার্মা ক্যাম্পেইনের তথ্যানুসারে মিয়ানমারে ১৯৮২ সালের পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইনে কেবলমাত্র ‘জাতীয় সম্প্রদায়’র মানুষ, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সূচনালগ্নে অর্থাৎ ১৮২৪ সাল থেকে বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে, তারাই পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকারী। অথচ ২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে প্রথমে মুসলিমদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে আত্মপরিচিতির সুযোগ থাকলেও পরে সেই স্বাধিকার খর্ব করে ‘বাঙালি’ হিসেবে গণ্য করা হয়। খোলাখুলিভাবে সেটাই তাদের বৈষম্য ও নিগ্রহে পর্যবসিত করেছে। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা অধিকার ও সমতাপূর্ণ কর্মসংস্থান হরণসহ সীমিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ভিত্তিতে এক অসহনীয় অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমি ২০১৩ সালে মিয়ানমারের হাসপাতাল ঘুরে দেখেছি অসুস্থদের তাদের ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক করে রাখা হয়েছে। এতে আশায় বুক বেঁধে অনেক রোহিঙ্গা মুসলিমই বঙ্গোপসাগরের পথে নৌকায় বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া অথবা ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। গত বছর সেই পরিস্থিতির আরও ক্রমাবনতি ঘটলে তারা ভূমধ্যসাগরের চেয়ে তিনগুণ ভয়ঙ্কর জলরাশি অতিক্রমের দুঃসাহস দেখিয়েছেন। জাতিসংঘের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ‘মানবপাচারকারীদের কবলে পড়ে সমুদ্রে জনস্ফীত নৌকায় আবদ্ধ থেকেছেন’, এমনকি ‘মুক্তিপণের জন্য প্রহারে বন্দি হয়েছেন’।
তথাপি গত বছরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের ফলে আশা জেগেছিল ৫০ বছরের সামরিক শাসনের যবনিকাপাত ঘটবে, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের জীবনমানের কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। ওই নির্বাচনের আট মাস আগেই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট অস্থায়ী নিবন্ধনের কার্ডগুলো বাজেয়াপ্ত করেন, ফলে অনেক রোহিঙ্গাই পরিচয়পত্রহীন হয়ে পড়েন এবং তাতে ভোটও দিতে পারেননি।
তারপরও ১৫ বছরের গৃহবন্দি মানবাধিকারের নেত্রী অং সান সুচির নির্বাচনি বিজয়ে তাকে প্রেসিডেন্ট হতে দেওয়া হয়নি, বরং বাধ্য হয়েই ‘স্টেট কাউন্সিলর’ হতে হয়েছে। বিশাল আশা জেগেছিল ক্ষমতাসীন হলে এই নোবেলজয়ী রোহিঙ্গাসহ নিষ্পেষিত সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় অবস্থান নেবেন। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সামরিক কর্তৃত্বে থাকায় পরিস্থিতির কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি, বরং বাস্তবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পরিচর্যা, সহযোগিতা ও সুরক্ষার অধঃগতি ঘটেছে। সাংবাদিকদেরও ওই অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।