স্বামী-সংসার হারানো প্রতিশোধের নেশায় নারী জঙ্গিরা দুর্ধর্ষ ১৪ নব্য জঙ্গিকে নিয়ে চিন্তিত র্যাব-পুলিশ
বিপ্লব বিশ্বাস: নব্য জেএমবির দীক্ষা নিয়ে উগ্রবাদের পথ বেছে নিচ্ছে জঙ্গি পরিবারগুলো। যে কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কর্মী পর্যায়ে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছে তারা। আবার যেসব জঙ্গি নিহত হচ্ছে তাদের স্ত্রীকে বিয়ে করছেন তাদেরই সহযোদ্ধারা। এছাড়া নিহতের স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেও এ পথ অনুসরণ করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গিবাদের এই চক্র থেকে বের হতে না পেরে অসহায় নারীরাও স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্বামী-সংসার হারানো প্রতিশোধের নেশায়ও তাদের ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদের এ পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে।
সম্প্রতি এ ধরনের তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। সর্বশেষ গত শনিবার আশকোনায় আত্মঘাতী নারী জঙ্গি শাকিরা ইতোপূর্বে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত ইকবালের স্ত্রী ছিল বলে তথ্য উঠে আসে। ইকবাল নিহত হওয়ার পর সন্তান সাবিনাসহ শাকিরাকে বিয়ে করে কথিত জঙ্গি সুমন। একইভাবে মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাকে হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছিল জঙ্গি মুসা। তবে শিলার সঙ্গে মুসার বিয়ে হয়েছিল কিনা তা এখনো তদন্তাধীন। শিলাও আত্মঘাতী নারী জঙ্গি বলে তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
সূত্র জানায়, জঙ্গিদের নারী শাখাটির সিদ্ধান্ত অনেক কঠোর। একেক জঙ্গি তাদের স্ত্রীদের দীক্ষা দিয়ে বলেছে,‘জিহাদের’ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোনোভাবেই পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। লড়াই করে ধরা পড়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজনে আত্মাহুতি দিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে আজিমপুরের অভিযানের সময় এক নারী জঙ্গি ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে ধরতে সমর্থ হয়।
পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মুখে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা তাদের স্ত্রীদের কাছে বার্তা দিয়ে জানিয়েছে, ‘তাদের খুঁজে পাওয়া না গেলে বা নিহত হলে জিহাদের প্রয়োজনে তারা নতুন সঙ্গী (স্বামী) বেছে নিতে পারবে।’ তারা মারা গেলে যোগ্যতার বিচার না করে সংগঠনের সদস্যদের মধ্য থেকে কাউকে বিয়ে করার নির্দেশনা রয়েছে নারী জঙ্গিদের প্রতি। বিভিন্ন সময় দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা তাদের হিজরতের সময় (বাসা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া) বা বড় কোনো সাংগঠনিক অপারেশনে যাওয়ার আগে নিজের স্ত্রীকে এমন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নিজেদের জঙ্গি স্বামীর মাধ্যমেই নারীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। তারা স্বামীর নির্দেশেই নিজেদের শিশুসন্তানদের জঙ্গিবাদের দীক্ষা দেয়। এমনকি কথিত জিহাদের প্রয়োজনে তাদের স্বামীরা নিহত হলেও তারা যাতে লক্ষ্যপূরণে সংগঠনের অন্য কাউকে বিয়ে করে নারী জঙ্গিদের কাছে সে নির্দেশনাও আছে।
অন্যদিকে, নব্য জেএমবির ভয়ঙ্কর ১৪ জঙ্গি ধরতে পুলিশ ও র্যাব দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় বিশেষ অভিযানে দুর্ধর্ষ সব জঙ্গি নিহত হলেও এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে নব্য জেএমবির তালিকাভুক্ত ১৪ জঙ্গি। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও গোয়েন্দা তৎপরতায় তাদের চিহ্নিত করা হয়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির পালিয়ে থাকা দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের মধ্যে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া, মারজান, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে শুভাষ, মাইনুল ওরফে মুসা, রাশেদ ওরফে রাশ, ইকবাল, রিপন, খালিদ, মানিক, মামুন, জোনায়েদ খান, আজাদুল কবিরাজ ও বাদল অন্যতম। এদের মধ্যে খালিদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে গেছে। অন্য পলাতক জঙ্গিরা নব্য জেএমবিকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।
জানা গেছে, স্বজনদের প্ররোচনায় নারীরাও হাঁটছেন জঙ্গিবাদের সর্বনাশা পথে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পুরুষ স্বজনরা আগে থেকেই জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকেন। পরে তারা পরিবারের নারী সদস্যসহ অন্যদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালান। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা শুরু থেকেই নিজেদের স্ত্রী-শ্যালিকা-বোনদের এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তবে কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে এখন পর্যন্ত বড় কোনো অভিযানে নারীদের দেখা যায়নি। তবে গত শনিবার আশকোনায় শাকিরা নামের ওই নারী আতœঘাতী হওয়ায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে গোয়েন্দাদের।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সম্প্রতি ইডেন কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পরই বদলে যেতে থাকেন ওই কলেজছাত্রী। বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। এক সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন আমেরিকায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কবে কোন ফ্লাইটে তারা আমেরিকায় গিয়েছে সেই তথ্যও জানতে পারেনি ওই দম্পত্তির পরিবারের সদস্যরা। গুলশান হামলার পর ওই নারীর বাবা রাজধানীর কলাবাগান থানায় এ ব্যাপারে একটি জিডি করেন। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম