মানবাধিকার সূচকে পিছিয়ে বাংলাদেশ: আইন ও সালিশ কেন্দ্র
শারমিন আজাদ: মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক এর তথ্য অনুসন্ধানের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবাধিকারের প্রধান দুটি সূচকের মধ্যে একটিতে অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে ইতিবাচক অগ্রগতি অব্যাহত থাকলেও মানবাধিকারের অপর সূচক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) ৮টি লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ২১টি টার্গেটের মধ্যে নির্ধারিত সময়ের আগেই ১৩টি টার্গেট অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়া, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতির উদাহরণ। অন্যদিকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি না হলেও এ ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপব্যবহার রোধে উচ্চ আদালতের রায়, সংসদ কর্তৃক বিচারক অপসারণ বিষয়ক বিধান নিয়ে সংশোধিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত মাননীয় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরেও ’৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালে ছয়টি রায় প্রদান করেছে এবং এ বছরে দুইজন যুদ্ধাপরাধীর দ-াদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
এতসত্ত্বেও ২০১৬ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বছরজুড়ে অব্যাহত ছিল। এছাড়া ২০১৬ সালে বিনা বিচারে আটক, গণগ্রেফতারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা ও বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা- ছিল ২০১৬ সালের অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। গত ১ জ্লুাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের পার্শ¦বর্তী স্থানে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর হামলার ঘটনা গভীর শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
সংস্থাটির মতে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনক ছিল ২০১৬ সাল। বছরের বিভিন্ন সময়ে হিন্দু পুরোহিত, সেবায়েত ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা ও জখম এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, প্রতিমা ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এছাড়া আদিবাসীদের ওপর হামলা-নির্যাতন ও উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে।
২০১৬ সালে নারী নির্যাতনের সংখ্যাগত দিকের পাশাপাশি এর মাত্রা ও ধরনে ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। এ বছরে নারী উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা এবং সালিশের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত বছরের চেয়ে বেড়েছে। অপরদিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও চলতি বছরের চিত্র ছিল হতাশাজনক। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র গুলিবর্ষণে সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও মানুষ উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে।
সংস্থাটি জানায়, সরকারের কাছে জনগণের যে প্রত্যাশা থাকে সে অনুযায়ী সরকারের উচিত মানবাধিকারের একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান বজায় রাখা। সকল পর্যায়ের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করাসহ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। জাতি, ধর্ম, মত নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি বলে আমরা মনে করি। সর্বোপরি মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে আমরা সরকারের আরও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করি। সম্পাদনা : আনিসুর রহমান তপন