আতঙ্কে শুরু, স্বস্তিতে শেষ গুলশন হামলাই টার্নিং পয়েন্ট
বিপ্লব বিশ^াস: আতঙ্ক থেকে স্বস্তি এ যেন নতুন বাংলাদেশ। গুলশান হলি আর্টিজনে জঙ্গি হানার আগে আর পরে একেবারে যেন ভিন্ন দুই বাংলাদেশ। ব্লগার রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মধ্যে দিয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি সারাদেশজুড়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, কয়েক দফা জঙ্গি আস্তানায় হানা আর জঙ্গিদের বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই ভয়ের কালো মেঘ এখন অনেকটাই ফিকে। অনেকটা স্বস্তির হয়ে উঠেছে মানুষের দিনযাপন। এমনকী জঙ্গিদের হুমকিতে যারা এত দিন শঙ্কিত ছিলেন, তারাও সেই দম আটকানো দিনগুলোতে এখন আর নেই।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে, তার বাড়ির সামনেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাজীব হায়দারকে। এ হত্যার পরই দেশে উস্কে দেওয়া হয় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক। শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা নাস্তিক- এটা প্রমাণে মাঠে নামল হেফাজতে ইসলাম নামের একটা সংগঠন। ২০১৩-র ৫ এপ্রিল প্রথম সমাবেশের পরে তারা ৫ মে ঢাকাতে দ্বিতীয় সমাবেশ করেছিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। তারা ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করে সেই সময়ে। তারা স্থায়ী অবস্থান মঞ্চ করার চেষ্টা করেছিল শাপলা চত্বরে। মাঝরাতের পরে র্যাব, পুলিশ আর বিজিপির মিলিত অভিযানে সেই অবস্থান তুলে দেওয়া হয়েছিল।
একের পর এক ব্লগার খুনের প্রতিবাদ: ৫ মে ২০১৩ রাজধানীর চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। এক দিনে এত নাশকতার দৃষ্টান্ত রাজধানী ঢাকাতে আর নাই। সে দিন গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বা কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে আগুনই শুধু দেওয়া হয়নি- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পাশে ইসলাম ধর্মগ্রন্থের দোকানে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। পল্টন এলাকাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় কেটে ফেলা হয়েছিল অজস্র গাছ। সেই কাটা গাছ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল রাস্তায়। সারা দেশেই এর আগে আরেক দফা অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার পর। তখন বগুড়ার গ্রামে রটিয়ে দেওয়া হলো এই যুদ্ধপরাধীকে নাকি আকাশের চাঁদে দেখা গেছে। সেই পরিকল্পিতভাবে রটানো গুজবের জেরে উন্মত্ততায়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় বেশ কয়েকজন।
২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকার হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলা চালায় জঙ্গিরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা এটি। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় নিহত হয় এক কিশোর, আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। পরের মাসে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে তার মুয়াজ্জিন নিহত হন। ডিসেম্বরে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত ও ১০ জন আহত হন। একই মাসে দিনাজপুরে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে বোমা বিস্ফোরণে ১০ জনেরও বেশি আহত হয়েছিলেন। সব হামলাতেই আইএস ও জেএমবি উভয়ই দায়িত্ব স্বীকার করে।
২০১৬ সালের শুরু থেকে একে একে যারা জঙ্গিবাদের শিকার হন, তারা হলেন- পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে হিন্দু পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ, ঝিনাইদহে শিয়া ধর্ম প্রচারক আব্দুল রাজ্জাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, সমকামী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কাগজ ‘রূপবান’ পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস মান্নান, নাট্য ও সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী মাহবুব তন্ময়, নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, রাজশাহীর তানোর উপজেলার পীর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বান্দরবানের চাক পাড়ার বৌদ্ধ ভিক্ষুক মংশৈ উ চাক, গোবিন্দগঞ্জের জুতা ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রমাণিক, নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি, পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পান্ডে, ঝিনাইদহের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ও বান্দরবানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মংশৈনু মারমা। এসব হত্যাকা-ের কয়েকটিতে আনসার-আল-ইসলামের নাম এলেও অধিকাংশ হত্যার জন্য আইএস দায়িত্ব স্বীকার করে। সেই দায় প্রচার করে রিটা কজের আলোচিত ওয়েব সাইট, ‘সাইট ইন্টেলিজেন্ট’। চোরাগোপ্তা, আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ইতিহাস থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের স্টাইলে পণবন্দি করার ঘটনা গুলশনের আগে বাংলাদেশে ঘটেনি। এটা বাংলাদেশের বুকে সবচেয়ে বড় জঙ্গি নাশকতাও বটে। হোলি আর্টিজান বেকারির ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র বদলে দেয়। সন্ত্রাসবাদীদের আর এক বিন্দু বরদাস্ত না করার কঠোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও এর এক সপ্তাহের মধ্যে ঈদের দিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইদের জামাত শোলাকিয়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে পুলিশের উপর হামলা করে জঙ্গিরা। নিহত হন এক পুলিশকর্মীসহ দুজন। তবে জঙ্গিদের নিশানা ছিল আরও অনেক বড়। সফলভাবে সেই বড় নাশকতার ছক রেখেছিল পুলিশ। বলা যায় তার পরই উল্টোপিঠ দেখতে শুরু করে জঙ্গিরা।
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর উত্তরা আশকোনা এলাকাতে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী ‘রিপেল ২৪’ নামের অভিযানে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী ও জঙ্গি তানভীর কাদেরীর কিশোর সন্তান আবিদ কাদের নিহত হয়। ওই বাড়িতে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গি সম্প্রতি নিহত জঙ্গি নেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী এবং পলাতক জঙ্গি মুছা ওরফে ইমতিয়াজের স্ত্রী, দুই শিশুসহ আত্মসমর্পণ করেছে। অভিযানে চার বছরের এক শিশু ও পুলিশের এক সদস্য আহত হন। এখানেই নারী জঙ্গি শারিকা (জঙ্গি সুমনের স্ত্রী) সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণে মারা যায়।
হলি আর্টিজান বেকারি আর শোলাকিয়া হামলার আগে পরের পরিস্থিতিতে এভাবেই ফারাক তৈরি হয়েছে বিস্তর। ১ আর ৭ জুলাইয়ের আগে জঙ্গিরা হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। আর ৭ জুলাইয়ের পরের স্রোত একদম উল্টোমুখি। এখন জঙ্গিরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের চাপাতির দাপট কার্যত শেষ। তবে পালিয়েও রক্ষা মিলছে না। তাদের প্রতিটি আস্তানার খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পুলিশ। জারি আছে একটার পর একটা অভিযান। যে কারণেই আর মাথা তুলতে পারেনি জঙ্গিরা। সাধারণ নাগরিকদেরও কেটে যাচ্ছে ভয় আর শঙ্কা।