এমপি লিটনের দাফন সম্পন্ন, আরও ৯ জন আটক শনাক্ত হয়নি খুনিরা : হত্যাকা- রহস্যাবৃত
আমিনুর রহমান তাজ ও রফিকুল ইসলাম: হত্যাকা-ের ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের খুনিদের শনাক্ত করা যায়নি। হত্যার মোটিভ এখনো রহস্যাবৃত।
এদিকে এই হত্যার ঘটনায় এমপির বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলি বাদী হয়ে গত রোববার রাতে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এজাহারে ৪ থেকে ৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। থানার অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমান বলেছেন, ‘মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে পুলিশ’। স্পর্শকাতর এই হত্যার ঘটনায় আরও ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর আগে যে ১৮ জনকে আটক করা হয় তাদের মধ্যে ১৫ জনকে লিটন হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বাকি ৩ জনকে অন্যান্য মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
এদিকে গতকাল রোববার সকালে রংপুর থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় আনা হয় এমপি লিটনের লাশ। সোমবার সকালে হিমঘর থেকে কফিন নেওয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। সেখানে লিটনের ২য় বার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় রাষ্ট্রপতির পক্ষে অংশ নেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারোয়ার হোসেন, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, গৃহায়ন ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী এম শাজাহান খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজমসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, এমপি মাহবুব-উল-আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ইকবালুর রহিম, বি এম মোজাম্মেল হক ও এমপি শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। জানাজার আগে লিটনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, লিটনের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ হিল বারী, মাহবুব-উল আলম হানিফ ও ফজলে রাব্বী মিয়া। বক্তারা বলেন, ‘এই হত্যাকা- জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত। গোলাম আযমকে সুন্দরগঞ্জের মাটিতে নামতে দেয়নি লিটন। এ কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে’।
জানাজার পর লিটনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারোয়ার হোসেন। ফুল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী নিহত এমপির পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দেন।
ঢাকায় জানাজার পর বেলা সোয়া একটায় এমপি লিটনের লাশ বহনকারী হেলিকপ্টারটি বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন সংলগ্ন জমিতে অবতরণ করে। হেলিকপ্টারটি বামনডাঙ্গা আব্দুল হক কলেজ মাঠে নামানোর কথা থাকলেও ওই মাঠে অবতরণ সম্ভব না হওয়ায় পরে কলেজ মাঠ থেকে আধ কিলোমিটার দূরে রেলস্টেশন সংলগ্ন জমিতে নামানো হয়। সেখান থেকে লিটনের মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সযোগে বামনডাঙ্গাস্থ শাহবাজ মাস্টারপাড়ায় তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় কফিনের সঙ্গে ছিলেন সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, লিটনের শোকাহত স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি, তার বড় বোন আফরোজা বুলবুল ও তৌহিদা বুলবুল এবং ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ হেল বারী।
লিটনের বাড়ির সামনে রাখা তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, ঢাকা থেকে আসা ডেপুটি স্পিকার অ্যাড. ফজলে রাব্বি মিয়া এমপি, হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি এমপি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপি, জাতীয় সংসদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ.এন. আশিকুর রহমান এমপি, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এমপি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সম্পাদকসহ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ কফিনে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। বাদ আছর বাড়ির সামনের আঙ্গিনায় ৩য় দফা নামাজে জানাজা শেষে লিটনকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ এই জানাজা ও দাফনে অংশ নেন।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে এমপি লিটনের কফিনে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানোর পর উপস্থিত সাংবাদিক ও শোকাহত জনগণকে উদ্দেশ্য করে এমপি নানক বলেন, ‘শেখ হাসিনার উন্নয়নকে ব্যাহত ও দেশের স্বাভাবিক অবস্থা অস্থিতিশীল করতে নানা অপশক্তি কাজ করছে। এই এলাকায় মৌলবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল যার প্রতিবাদ করেছিলেন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই এই অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হবে’।
এমপি লিটনের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ যৌথভাবে রোববার সকাল-সন্ধ্যা এবং সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল পালন করে। হরতাল চলাকালে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ থাকে। সোমবার সকাল ৭টায় লালমনিরহাট থেকে ছেড়ে আসা সান্তাহারগামী লোকাল ট্রেনটিকে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনে আটক করে রাখা হয়। লিটনের মরদেহ সুন্দরগঞ্জে আসার পরই হরতাল প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। হরতাল চলাকালে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নেতাকর্মীরা বলেন, সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী জঙ্গি চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণেই এমপি লিটনকে হত্যা করা হয়েছে। তারা বলেন, ইতোপূর্বে জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গোটা সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় দুদিনব্যাপী তা-ব চালায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ সময় রেললাইন উপড়ে ফেলা, সুন্দরগঞ্জ থানা ও বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে ৪ জন পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া একজন রিকশাচালক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে হত্যা করে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক চক্র পরিকল্পিতভাবে লিটনকে হত্যা করেছে বলে তারা দাবি করেন।
লিটন হত্যার প্রতিবাদে গাইবান্ধায় জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে গতকাল সোমবার সকালে নিজ নিজ ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে মানববন্ধনের কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধন থেকে লিটনের খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
উল্লেখ্য, গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি লিটন গত শনিবার সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের নিজ বাড়িতে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন