চার শতাধিক ছবির অভিনেত্রীর দিন কাটে অনাহারে!
আউয়াল চৌধুরী: আমার ঘর নেই, বাড়ি নেই, সংসার নেই। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংসার করছি ৪৪ বছর ধরে। এ কথা বলে একটু থামলেন। চোখ ছলছল করে উঠলো রাবেয়া খাতুনের, ফিরে গেলেন অতীতে। ‘১২ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। তারপর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়। সংসার চলছিল বেশ সুখেই। এর মাঝে শুরু হয় মুক্তি যুদ্ধ।’ ’৭১ এর যুদ্ধে আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। কোথায় যাবো কি করবো কিছুই জানিনা। আমরা তখন থাকতাম রায়ের বাজার। একদিন মিলিটারি এসে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আমরা পাগলের মত হয়ে গেলাম। আমরা ছিলাম তিন বোন এক ভাই। আমি সবার বড়। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাবেয়া খাতুন চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমাদের ভয় উৎকণ্ঠায় দু’চোখে তখন ঘুম নেই। বাবার চিন্তায় পাগল হওয়ার মত। আমার ছেলের বয়স তখন তিন বছর আর মেয়েটি ছিল আমার পেটে। তারপর একদিন দেখি বাবা আবার ফিরে এসেছে। বয়স্ক মানুষ হওয়ায় তারা বাবাকে জানে মারে নাই, ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের কলিজায় তখন পানি আসে। এরপর আমরা রায়ের বাজার ছেড়ে গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ বন্দরে চলে যাই। সেখানে গিয়েও ভয়, রাতে ঘুমাইতে পারতাম না। জঙ্গলে এখানে সেখানে রাত কাটাতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলে আসি ঢাকার মোহাম্মদপুরে।
মোহাম্মদপুরের বাটা সু এলাকায় আমাদের জীবন চলা আবার শুরু হয়। কিন্তু এরই মাঝে আমার জীবনে ঘটে যায় একটি বড় দুর্ঘটনা। আমার স্বামী অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। আমার সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। কি করবো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ছোট ছোট ভাই বোন আর নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমি কাজে নেমে পড়ি। আমার স্বামী সুখের সংসার করতে থাকে অন্য মেয়ে নিয়ে। এরপর আমাদের পাশের বাসার এক মহিলা তখন এফডিসিতে কাজ করতো। তিনি আমাকে ১৯৭২ সালে এই এফডিসিতে নিয়ে আসে। তখন থেকেই এটি আমার সংসার। আমার জীবন। আমার সব কিছু।’
আবার কেন বিয়ে করলেন না এ প্রশ্ন করতেই রাবেয়া খাতুন বলেন, মনের দুঃখে আর বিয়ে করবো না চিন্তা করেছিলাম। তাছাড়া ছোট ছোট ভাই বোন, তাদের মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এদিকে যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে বাবাও মারা যায়। কিন্তু আজ জীবনের এই শেষ মুহুর্তে এসে মনে হচ্ছে বিয়ে করলে ভাল হত। অন্তত একজন মানুষের সহযোগিতা পেতাম।
আপনার ছেলে কোথায়, সে কি কিছু করে না। এ প্রশ্ন করতেই রাবেয়া খাতুনের চেহারাটা মলিন হয়ে গেল, চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। আমার ছেলেতো নেইরে বাবা, হারিয়ে গেছে। আমার স্বামী আমারে ছেড়ে যাওয়ার পর আমার কলিজাটা ১৫ বছর বয়সেই কোথায় যে হাওয়া গেল তার কোনো হদিস পাইলাম না। আজো তাকে আমি খুঁজি সবখানে, কোথায় সে হারিয়ে গেল, কেন গেল। রাবেয়া খাতুন ছেলের কথা বলতে বলতেই হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। এরপর কিছুক্ষণ উদাস হয়ে গেলেন। তারপর অবলম্বনের আশায় রাবেয়া খাতুন একটা পালকপুত্র নেন। তাকে আপন সন্তানের মত মানুষ করা শুরু করেন। আজ তার সংসার হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে, কিন্তু তার টানাটানির সংসারে রাবেয়া খাতুনের আর ঠাঁই হয়ে উঠে না।
চলচ্চিত্রে কার কার সঙ্গে কাজ করেছেন জানতে চাইলে রাবেয়া খাতুন বলেন, চারশ’র উপরে সিনেমায় আমি কাজ করেছি। মা-বোন, আয়া, নানী ও স্ত্রী চরিত্রেও অভিনয় করেছি। নায়ক রাজ্জাকের ছবি জন্মদাতাতে আয়ার কাজ করেছি। নায়ক জসিমের লালু মাস্তান ছবিতে একটি বাচ্চার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। নায়ক জাফর ইকবালের সোনার পাল্কী ছবিতে নানীর চরিত্রে অভিনয় করেছি। এপার-ওপার, নাগর দোলা, অবিচার, সুন্দরী, কসাইসহ আরও অনেক ছবি, এখন আর মনে নেই।
একটি ডায়ালগ বলতে পারবেন বলতেই তিনি বলেন, নায়িকা শাবানা এক ছবিতে একবার আমার ঘরের দরজায় এসে আওয়াজ দিয়ে বলেন, আমারে কাজে রাখবেন, তখন আমি বলি আমিতো কাজের লোক, আপনারে আমি কেমনে রাখবো।
জীবনের বহু স্মৃতি রাবেয়া খাতুনের মনের কোণায় জমা হয়ে আছে। তার ঘর ছিল, স্বামী ছিল, সন্তান ছিল ও সংসার ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। এই চলচ্চিত্রই তার সংসার। থাকার তার কোনো জায়গা নেই, একজন দয়া করে তাকে ঘুমুবার জন্য একটু জায়গা দিয়েছে- এখন সেখানেই রাবেয়া খাতুন জীবনের হিসাব মেলাচ্ছেন।
বর্তমানে রাবেয়া খাতুনের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। ঠিকমত খাবার জোটেনা, থাকতে হয় অনাহারে। শরীরে নানা রোগ ব্যাধি বাসা বেধেছে। ডায়াবেটিস প্রেসার হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, চোখের আলো আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে, বাম চোখ দিয়ে এখন আর দেখতে পান না, ডান চোখটা অনেকটা ঘোলা ঘোলা লাগে। কিন্তু চিকিৎসা করার সামর্থ্য তার নেই।
রাবেয়া খাতুন নি:স্ব আজ ভিশন ভারী। জীবন আর তার চলে না। কত কষ্ট কত ব্যথা বেদনাকে চাপা দিয়ে তিনি এই ফিল্মের মোহে এখনো বিচরণ করছেন আপন ভুবনে। এমন রাবেয়া খাতুনদের অবদানেই একদিন এই চলচ্চিত্র তার আসল পথ খুঁজে পাবে। ফিরে আসবে স্ব-মহিমায়। সম্পাদনা: এনামুল হক। ছবি তুলেছেন : আবু সুফিয়ান রতন