প্রশাসনের তালিকায় আগৈলঝাড়ার ৫৩ রাজাকারের নাম
শামীম আহমেদ, বরিশাল: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ত্রপ্রাপ্ত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস সদস্যদের উপজেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে অতিগোপনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন। তালিকায় ১৪ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত রাজাকারসহ মোট ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে স্থানীয় প্রশাসনের প্রথম তৈরি করা তালিকায় রয়েছে ১৩ যুদ্ধাপরাধীর নাম।
অতিসম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের এই তালিকার বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাকসুদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত স্মারক মোতাবেক বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্মারক অনুযায়ী আগৈলঝাড়া উপজেলার সদ্যবিদায়ী নির্বাহী অফিসার দেবী চন্দ্র গত বছর (২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি) আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৪ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত রাজাকারসহ মোট ৪০ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, একটি স্মারকের মাধ্যমে উপজেলার ৫ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের কাছে রাজাকারদের তালিকা প্রস্তুত করে ইউএনওর কার্যালয়ে পাঠানোর অনুরোধ করা সত্ত্বেও ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে রাজাকারদের কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে ১৪ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত যুদ্ধাপরাধী রাজাকারসহ মোট ৪০ জনের একটি তালিকা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা দেওয়া হয়। পরে তদন্ত সাপেক্ষে ওই তালিকা বহাল রেখে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে।
১৪ জন জীবিত যুদ্ধাপরাধী হলেনÑ আগৈলঝাড়ার গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া গ্রামের মাওলানা শিহাব উদ্দিন খান ও তার পুত্র বদর বাহিনীর অন্যতম সদস্য মো. ইসফাকুর রহমান তোতা, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের এসকেন্দার আলী সিকদার, পূর্ব সুজনকাঠী গ্রামের মোহাম্মদ সরদার, গৈলা গ্রামের সাদবিম রাব্বি মুকুল ও তার সহোদর আবুল হোসেন বাচ্চু, পতিহার গ্রামের সিরাজ উদ্দিন সিরু, ফুল্লশ্রী গ্রামের রেজাউল পাইক ও বসির ফকির, বাকাল গ্রামের আমিনুল ইসলাম ওরফে দাদন আলী, জবসেন গ্রামের মোসলেম পাইক, ফুল্লশ্রী গ্রামের বজলুর রহমান ফকির, বাকাল গ্রামের আব্দুর রশিদ সরদার ও আমবৌলা গ্রামের জয়নাল হাওলাদার।
২৬ জন মৃত যুদ্ধাপরাধী হলেনÑ গৈলা ইউনিয়নের মধ্যশিহিপাশা গ্রামের মৃত মুন্সি আফতাব উদ্দিন ভাট্টি ও তার পুত্র সাহেব আলী মুন্সি ওরফে ভাট্টি, কালুপাড়া গ্রামের মুন্সি নজিবর রহমান মোল্লা, পূর্ব সুজনকাঠী গ্রামের হালিম দাড়িয়া, ওমর আলী সরদার, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের মতিউর রহমান সরদার, সৈয়দ আলী হাওলাদার, আব্দুল কাদের হাওলাদার, মহম্মদ আলী ভূইয়া, ডা. সিরাজ উদ্দিন সরদার, সেকান্দার আলী, মধ্যশিহিপাশা গ্রামের জয়নাল ভাট্টি, তার দুই পুত্র খালেক ভাট্টি ও ছত্তার ভাট্টি, জবসেন গ্রামের মান্নান পাইক, সাত্তার পাইক, ফুল্লশ্রী গ্রামের রব পাইক, মোক্তার মোল্লা, বাকাল গ্রামের সলেমান সরদার, মফিজ উদ্দিন সরদার, ফুল্লশ্রী গ্রামের মকবুল ফকির, সোনামদ্দিন খলিফা ও তার ভাই মোহন, নজর আলী ফকির, সুলতান মোল্লা ও জবসেন গ্রামের আব্দুল হক ফকির।
সূত্র মতে, এর আগে ২০১০ সালের ৫ আগস্ট সিটিএসবির একটি স্মারকে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে পাঠানো বার্তা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে স্থানীয় প্রশাসন অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম তালিকা তৈরি করেন। প্রথম তালিকায় উপজেলায় ১৩ জনের নাম স্থান পায়। এর মধ্যে বর্তমানে ৪ জন জীবিত ও ৯ জন মৃত। প্রথম তালিকায় ৭ জন রাজাকার, ৩ জন পিস কমিটি, দুজন জামায়াত ও একজন আল-বদর নেতার নাম রয়েছে। জীবিতরা হলেনÑ কালুপাড়া গ্রামের ইসফাকুর রহমান তোতা ও মাওলানা শিহাবুদ্দিন খান এবং উত্তর শিহিপাশা গ্রামের এসকেন্দার আলী শিকদার ও ইদ্রিস সরদার। মৃতরা হলেনÑ মধ্যশিহিপাশা গ্রামের আফতাব উদ্দিন মুন্সি, হালিম দাড়িয়া ও সাহেব আলী মুন্সি ওরফে ভাট্টি, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের মতি সরদার, সৈয়দ আলী হাওলাদার, ডা. সিরাজ উদ্দিন সরদার ও কাদের হাওলাদার, গৈলা গ্রামের নজিবুর রহমান মোল্লা ওরফে নাজেম মুন্সি এবং ফুল্লশ্রী গ্রামের নজর আলী ফকির।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অসংখ্য হত্যাযজ্ঞের হোতা মুসফিকুর রহমান তোতা বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের উজিরপুরের স্বনির্ভর শাখায় কর্মরত। মাওলানা শাহাবুদ্দিন খান দীর্ঘদিন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের পদে থেকে বর্তমানে বার্ধক্যের কারণে নিজ গৃহে অবস্থান করছেন। এসকেন্দার আলী শিকদারকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করলে এক পা হারিয়ে অন্য পায়ে ভর করে স্বাধীনতাপরবর্তী দীর্ঘসময় তিনি কুমারভাঙ্গা এলাকায় অবস্থান করে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওই এলাকার স্থানীয় বিএনপির তালিকাভুক্ত নেতা।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ইউনিয়ন কমান্ডাররা, এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের অভিযোগÑ দুটি তালিকা প্রণয়নের পরেও সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা সম্পন্ন হয়নি। রাজিহার ইউনিয়নে রাজাকারদের প্রধান ছিলেন মৃত আদেল উদ্দিন ফকির। তার সহযোগী ও লুটেরা হিসেবে গ্রামে লুটতরাজ চালাতেন বসুন্ডা গ্রামের আব্দুল আজিজ ও জালাল মোল্লা। সেসব দিনের চিহ্নিত লুটেরা আজিজ মোল্লা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কৌশলে কাগজপত্র তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছেন। উত্তর শিহিপাশা গ্রামে মৃত হানিফ হাওলাদার, তার ভাই মৃত এনায়েত হাওলাদার ও সামসুল হক হাওলাদারের নেতৃত্বে চলে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ আর হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের লোমহর্ষক ঘটনা। সামসুল হক বর্তমানে সান-লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে গৈলায় কর্মরত। আমবৌলা গ্রামের মৃত সাহেব আলী তালুকদার ছিলেন ওই ইউনিয়নের পিস কমিটির সভাপতি। এলাকায় একাধিক গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরে সাহেব আলী রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হন। বাগধা গ্রামের মৃত কাশেম হাওলাদার, কালাম হাওলাদার, পশ্চিম বাগধা গ্রামের খালেক খান পিস কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে এলাকায় গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাগধা গ্রামের দেবেন চ্যাটার্জীকে হত্যা করে তার পুরো বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে মহলটি। ফলে বাধ্য হয়ে ওই পরিবারের সদস্যরা ভারত চলে যায়। একই গ্রামের কালীপদ সমদ্দারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। কালীপদের স্ত্রী এখনও ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সকল সহায় সম্পত্তি এখন স্বাধীনতাবিরোধীদের দখলে। বারপাইকা গ্রামের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আজিজ মোল্লার নামও তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক তথ্য পেলে প্রয়োজনে পুনরায় আরও একটি নতুন তালিকা গঠন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সম্পাদনা : মুনওয়ার আলম নির্ঝর