হত্যার প্রতিবাদে সুন্দরগঞ্জে তিনদিনের শোক জামায়াত-শিবিরচক্র এমপি লিটনকে হত্যা করেছে :এমপির স্ত্রী স্মৃতি
রফিকুল ইসলাম, গাইবান্ধা: সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের শাহবাজ মাস্টারপাড়া গ্রামের এমপি লিটনের যে বাড়িটি কর্মী সমর্থকদের উৎফুল্ল পদচারণায় এক সময় মুখর হয়ে থাকতো, সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতার মাঝেও এমপি লিটনের কবর জিয়ারত করতে এবং তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা শোকার্ত মানুষের ভিড়। সামিয়ানাজুড়ে চলছে কুরআনখানি ও কাঙালিভোজ পর্ব। গোটা বাড়িতেই পুলিশ-র্যাব সদস্যদের ভিড়। মঙ্গলবার এর মাঝেই এমপি লিটনের বাড়ির সামনে সেই প্রিয় গাবগাছ তলায় উপস্থিত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের অনুরোধে লিটনের শোকে মুহ্যমান অসুস্থ স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি তাদের সাক্ষাৎকার দিলেন। শোকাহত এই ঘটনার পর এই প্রথম তার সাংবাদিকদের সামনে পরিস্থিতি সম্পর্কে তার বিবরণ তুলে ধরা এবং অনুভূতি বর্ণনা করা। স্মৃতি জানান, বিগত ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডাব্লিউ ডিগ্রি কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত জনসভায় গোলাম আযমের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। সে সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এই সভা প- করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লিটন তার বন্দুক হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ওই জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এতে জনসভাটি প- হয়ে যায়। ফলে সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যে কোনো মূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল। সে সময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে এবং মোবাইল করে দীর্ঘদিন থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। লিটনকে ৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় গুলি করে এই নির্মম হত্যা তারই জের বলে উলেখ করে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ওই গোলাম আযমের জামায়াত-শিবিরের খুনিরাই তার স্বামীকে হত্যা করেছে। তিনি মর্মান্তিক এই হত্যার বিচার চান এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোঁড়ার একটি পরিকল্পিত মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শর্টগান জব্দ করে নেওয়া হয়। খুনি জামায়াত-শিবিরচক্র জানতো তার বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মত কোনো অস্ত্র নেই। সেই সুযোগে তারা বাড়িতে এসে পরিকল্পিতভাবে খুনিরা তাকে হত্যা করতে সাহসী হয় বলে স্মৃতি জানান।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন বিকালে অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতো। এছাড়া তার বাড়িতে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে এমপি লিটন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন তার অফিসে গিয়ে বসেন এবং রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকেন। কিন্তু কেন জানি না সেদিন কোনো নেতাকর্মী তার বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে শুধু তিনি তার ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার, ভাগ্নি শিমু, চাচি স্মৃতি খাতুন এবং বাড়ির কেয়ার টেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র ছিল। এ সময় তিনি ও তার ভাই বাড়ির উঠোনের রান্না ঘরের কাছে ছিলেন। সে সময় গুলির শব্দ শুনতে পান এবং লিটন ঘর থেকে বাড়ির ভেতর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বলেন ওরা আমাকে গুলি করেছে, আগে ওদের ধরো। এ সময় তিনি বুকে হাত দিয়ে ছিল এবং বুকের বাম পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। বাড়ির সামনে ড্রাইভার এমপির চিৎকার শুনে এবং আততায়ীদের ছুটতে দেখে গাড়ি নিয়েই তাদের ধাওয়া করেন। আহত লিটনকে সাথে নিয়ে স্মৃতি, ইসমাইল ও বেতার গাবগাছ তলায় বেরিয়ে আসেন। সে সময় আহত লিটন দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিল না। ড্রাইভার ও গাড়ি না থাকায় একটি মাটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে আহত লিটনের কথামত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ড্রাইভার এসে পড়লে সেই গাড়িতে চড়েই প্রতিবেশী নয়ন ও রেজাউল এবং বেতারসহ এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বলে জানান।
তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সুন্দরগঞ্জে দলীয় কোনো কোন্দল নেই। লিটন এমপি হিসেবে অত্যান্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তবে তার একমাত্র শত্রু ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরচক্র। যাকে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। যার প্রতিশোধ তারা এই ত্যাগী নেতার রক্ত ঝরিয়ে নিয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমপির শ্যালক সৈয়দ বেদারুল ইসলাম বেতার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, যে দুজন খুনি লিটনের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে তার সাথে ঘরে ঢোকেন তারা গিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়েন। খুনি দুজনার মুখ খোলা থাকলেও মাথা ও কান মাপলারে ঢাকা ছিল এবং তাদের পরনে ছিল কালো জ্যাকেট ও কালো প্যান্ট। তারা বহিরাগত ছিল না, কারণ তারা গাইবান্ধা এলাকার আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কথা বলছিল। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, গুরুতর আহত লিটনকে নিয়ে যখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিল তখন তার শেষ দুটো কথা ছিল, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। তার অক্সিজেনের দরকার। এরপর তিনি চিৎকার করে স্ত্রী স্মৃতিকে বলেন, স্মৃতি হাসপাতাল আর কতদূর। এটাই তার শেষ কথা। এরপর সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
লিটন হত্যা মামলায় আটক ৩ : লিটন হত্যা মামলায় মঙ্গলবার আরও ৩ জনকে আটক করেছে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ। এ নিয়ে চারদিনে এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ মোট ২৭ জনকে গ্রেফতার করল। এদিকে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও মোবাইল ট্যাকিং করে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করছে।
হত্যার দিন খুনিরা দুবার তার বাড়ির সামনে আসে : হত্যাকা-ের দিন ওই মাঠে আশপাশের ছেলেরা প্রথমে ক্রিকেট ও পরে লিটনের দেওয়া ভলিবল দিয়ে খেলাধুলা করছিল। আর এমপি লিটন সেই খেলা দেখছিল তার বাড়ির সামনে গাবগাছের নিচে বসে। বিকাল ঠিক ৪টায় মূল কিলারের দুজন সহযোগী প্রথমে রেকি করতে আসে এবং ওই ছেলেদের ভলিবল খেলা বন্ধ করে বাড়ি যেতে বলে। এ সময় জুয়েল নামে একটি কিশোর ওই দুজনার সাথে তর্ক করে। আমরা এমপির মাঠে খেলছি তাতে আপনাদের কি? এরপর তারা দুজন চলে যায় এবং পরে দুটি মোটরসাইকেলে আবার ৫ জন ফিরে আসে। খুনিরা সবসময়ই পরস্পরের সাথে মোবাইলে কথাবার্তা বলছিল বলেও জানা গেছে। এদিকে দুজন একটি মোটরসাইকেল নিয়ে রেললাইনের কাছে এবং একজন বাড়ি সংলগ্ন গাব গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মোটরসাইকেল চালকই খুনিদের নিয়ে পালিয়ে যায়। যাদের লিটনের ড্রাইভার পরে ধাওয়া করেছিল বলে জানা গেছে।
লিটনের কবর জিয়ারত করেছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী : কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মঙ্গলবার তার দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে এসে এমপি লিটনের কবর জিয়ারত করেন। পরে লিটনের স্ত্রী এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করে গভীর শোক জ্ঞাপন করেন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বলেন, মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মতো সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য যদি তার নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে খুনিদের হাতে নিহত হন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? অথচ সরকার বলছেন, দেশে কোনো সমস্যা নেই, অশান্তি নেই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি অনেক উন্নত। তিনি এই নির্মম হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করে ন্যায্য বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, দেশে এখন ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। সুতরাং, মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এই সরকারের বিরুদ্ধে। যারা সাধারণ মানুষকে নিজ বাড়িতে বসবাসের নিরাপত্তা দিতে পারে না।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩ দিনের শোক কর্মসূচি : এমপি লিটনের হত্যার ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিনদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ এ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হওয়া তিনদিনের শোক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ, মানববন্ধন, ৫টি মাদ্রাসায় দোয়া-মাহফিল ও কুরআনখানি। লিটন হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবিতে উপজেলা আওয়ামী লীগ তিনদিনের শোক কর্মসূচির আয়োজন করে।
গাইবান্ধায় বিক্ষোভ সমাবেশ : এমপি লিটন হত্যার প্রতিবাদে গাইবান্ধা শহর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মঙ্গলবার স্থানীয় শহীদ মিনার চত্বরে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ-শামস-উল-আলম হিরু, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, মোজাম্মেল হক ম-ল, দীপক কুমার পাল, রেজাউল করিম রেজা, এমারুল ইসলাম সাবিন, মৃদুল মোস্তাফিজ ঝন্টু, সর্দার মো. সাঈদ হাসান লোটন, রাহাত মাহমুদ রনি, এসকে তাসের আলী প্রমুখ।
সুন্দরগঞ্জে দিনভর বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ : সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল চত্বরে এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আবু বকর সিদ্দিক, ফরহাদ আব্দুল্যাহ হারুন বাবলু, সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র আব্দুল্যাহ আল মামুন, সাজেদুল করিম প্রমুখ। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও পৌর আওয়ামী লীগ এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে।
সুন্দরগঞ্জ ডি ডাবিউ ডিগ্রি কলেজে শোক সভা : বিদায়ী বছরের শেষ দিনে দুবৃর্ত্তের গুলিতে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যার প্রতিবাদে সুন্দরগঞ্জ ডি ডাবিউ ডিগ্রি কলেজের উদ্যোগে এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার দুপুরে কলেজ হলরুমে অনুষ্ঠিত শোক সভায় অধ্যক্ষ এ.কে.এ.এম. হাবিব সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য নাসরিন সুলতানা, লুৎফর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, কলেজ শিক্ষক আব্দুল হান্নান সরকার, আব্দুল জলিল সরকার, মশিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রউফ, মঞ্জুরুল ইসলাম, সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। শোক সভায় এমপি লিটনের মাগফিরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করে ও মুনাজাত দোয়া পরিচালনা করা হয়।
প্রসঙ্গত উলেখ্য যে, গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন শনিবার সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৭টায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন