গুলশান ডিসিসি মার্কেটে ভয়াবহ আগ্নিকা- ৬০৫ দোকান পুড়ে ছাই
আজাদ হোসেন সুমন ও মাসুদ আলম: রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর ডিসিসি কাঁচা ও সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে মার্কেট দুটির ৬০৫টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২২ ইউনিট ১৫ ঘণ্টা টানা চেষ্টা চালিয়ে মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে আগুন আনতে সক্ষম হয়। ভয়াবহ এই অগ্নিকা-ের ঘটনাকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এটি দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা। ইচ্ছাকৃতভাবেই দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক বলেন, মার্কেটের অগ্নিকা- কোনো নাশকতা নয়, এটি দুর্ঘটনা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক ক্রটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে সোমবার রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে মার্কেটে আগুন লাগে। সংবাদ পেয়ে রাতেই দোকান মালিকরা আসে তারা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। না পেরে তারা দোকান থেকে মালামাল বের করে আনতে চেষ্টা করে ব্যবসায়ীরা। সকালে মার্কেটের পিছনের দিক দিয়ে ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে কিছু কিছু মালামাল বের করে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা থেকে সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। ততক্ষণে দমকলের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কালো ধোঁয়ার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। পানি স্বল্পতার কারণে আগুন নেভানোর প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। লেক থেকে পানি সংযোগ দেওয়া হলেও পর্যাপ্ত পানি আসেনি। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সকালে আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় দুর্ঘটনাকবলিত মার্কেট ঘিরে। কিন্তু তাদের শ’শ’ কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে এ দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। মানুষের ভিড়েও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ট্রাফিক পুলিশ আশপাশের যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। কিন্তু উপচেপড়া উৎসুক মানুষের ভিড় আর পানি স্বল্পতায় আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থেকে যায় দমকল কর্মীদের। খবর পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের বড় কর্তারাও ছুটে আসেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় ব্যবসায়ীদের মাঝে আহাজারি শুরু। চিৎকার, চেচামেচি, কান্নাকাটি, হৈ হুল্লোড়ে গুলশান এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। আগুন জ্বলছে- নিজের দোকান, কোটি কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। আগুন নেভাতে দমকল কর্মীদের আন্তরিকতার প্রশ্ন তোলেন। গতকাল দিনশেষে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু আগুনের ভয়াল থাবায় ছাই হয়ে যায় ডিএনসিসি মার্কেটের ৬০৫টি দোকান। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধনকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
কিন্তু ডিসিসি কাঁচাবাজার দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আখতারুজ্জামান বলেন, ডিসিসি মার্কেটে পরিকল্পিতভাবেই আগুন দেওয়া হয়েছে। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা। কারণ, এতো খোলামেলা জায়গায় কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি? দীর্ঘদিন ধরে সিটি কর্পোরেশন তাদেরকে দোকান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই মার্কেটটিকে সিটি কর্পোরেশন একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছে। তারা আমাদেরকে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। মার্কেটটি নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন আমাদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছে। মেয়রের অনুরোধে আমরাও একটা প্রস্তাব দিয়েছি। একে ইন্টারন্যাশনালের মালিক নাজমুল হুদা বলেন, রাত ৩টায় খবর পেয়ে মার্কেটে আসে দেখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলায় তার একটি দোকান ছিল। দোকানে কোটি টাকার ওপরে মালামাল ছিল। সবকিছু পুড়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও জরুরি কাগজপত্র ছিল। দোকানই ছিল তার শেষ সম্বল। তিনি ভাটারা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। সাদিয়া ফ্রেবিক্স এন্ড টেইলার্সের মালিক আফরোজা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ভাই আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। দোকানে ৭০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। এখন কি করে খাবো। কোনো উপায় না পেয়ে মার্কেটের পিছনের দেয়াল ভেঙে কিছু মালামাল বের করেছি। ধোঁয়ার কারণে ভেতরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। প্রত্যেকটি দোকানে ৫০ লাখ টাকার ওপরে মালামাল ছিল।
মার্কেটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসির মার্কেটে ৬০৫টি দোকান ছিল। তার অধিকাংশই পুড়ে গেছে। দুই দুই বার ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের পানি শেষ হয়ে গেছে। মার্কেটের দুই পাশেই লেক রয়েছে। তারা সেখান থেকে পানি আনতে পারতো। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আন্তরিকভাবে কাজ করেনি। মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী মো. মিলন মিয়া বলেন, রাতে মার্কেটে তার ডিউটি ছিল। রাত ২টার পর হঠাৎ আগুন দেখে তিনি মার্কেট কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের জানান। রাতে মার্কেটে নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না।
ডিসিসি কাঁচা বাজার মার্কেটের সভাপতি শের মোহাম্মাদ বলেন, ১৯৮৩ সালে মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়। সে সময়ই ৪০০টি দোকান নিয়ে দ্বিতলা ভবন নির্মিত হয়। ৬তলা ফাউন্ডেশনের মার্কেটটি পরে ১৯৯৬ সালে বর্ধিত করা হয় তিন তলায়। ডিসিসি সুপার মার্কেটের সভাপতি তালাল রিজভী বলেন, দুটি মার্কেটে ৬০৫টি দোকানই পুড়ে গেছে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর দেনা রয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকা-ের ঘটনা দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতা- তা খতিয়ে দেখতে সব পক্ষকে নিয়ে তদন্ত করতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগে। কখনো বস্তির ঘর পুড়ে যায়, কখনো দোকানপাট পুড়ে যায়। সেখানে যারা বসবাস করত, তারা চলে গিয়ে আরও কিছু নতুন লোকজন সেখানে বসবাস করা শুরু করে। এভাবে চলতে পারে না।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছে। কি কারণে আগুনের সূত্র তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দমকল কর্মীদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলায় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সম্পর্কে মেজর শাকিল এ প্রতিবেদককে বলেন, খতিয়ে দেখা হবে। কারো বিরুদ্ধে দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, খুব কম ঘটনা আছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয় না। ক্ষতিগ্রস্তরা রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে প্রাথমিকভাবে দমকল কর্মীদের দোষারোপ করে থাকেন। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম