শিশু রাকিবের জ্যামের দোকান!
রিকু আমির: স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবের দোকানের নামধাম নেই। তারপরও তার মুখ থেকেই শোনা গেল তার দোকানের নাম ‘জ্যামের দোকান’! দোকানটির অবস্থান ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাটুরিয়া ফেরিঘাটের খুবই কাছে। রাকিবের নাগাল পাওয়া যায়, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন গত শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে তার জ্যামের দোকানে। যেখানে রাকিব দোকানদারি করছিল একাই। এক পাশে আদাযোগে রঙ চা, অন্যপাশে ডিম ও ময়দার রুটি। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল- তখন পাটুরিয়া ফেরিঘাটে শতশত যানবাহন আটকা, কারণ ঘন কুয়াশা। এ চিত্র প্রতিবছরই এখানের স্বাভাবিক চিত্র।
জ্যামের দোকান মানে কী- প্রশ্ন করতেই শিশু রাকিবের মুখ থেকে চটচট উত্তর- বুঝলেন না, এই রাস্তায় তো হগ্গল সময় জ্যাম থাকে না। যখন জ্যাম থাকে তখনই দোকানদারি করা হয়। জ্যামের দোকান নাম শোনার আগে রাকিব একজন ভোক্তার জন্য রঙ চা তৈরি করছিল। সে তখন আদা কাটছিল ছোট একটি কাঁচি দিয়ে। এরপর আরেকজন ভোক্তা ফরমায়েশ দেন- কাঁচামরিচ ও পিঁয়াজ বেশি দিয়ে একটি মুরগির ডিম ভেজে রুটি দিয়ে রোল করে দিতে। তখনও রাকিব কাঁচামরিচ ও পিঁয়াজ কাটতে শুরু করে সেই কাঁচি দিয়েই। কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হচ্ছিল রাকিবকে। তারপরও রাকিব কেটে ডিম ভেজে ফেলে।
এসময় দোকানের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী ৪/৫ জন রাকিবের কাঁচির কাজ দেখে পরামর্শ দেন, দোকানে বটি-চাকু রাখতে বা বাড়ি থেকে এসব কাটাকুটি করে নিয়ে আসতে। তখনই রাকিব বলে উঠে- এইটা তো জ্যামের দোকান। জ্যাম হইলেই দোকান হয়, জ্যামের তো গ্যারান্টি নাই। তাই আমার দোকানের ঠিক নাই, মালপত্রেরও ঠিক নাই। আমি তো জানি, চাকু-দাউ রাখলে ভাল, কাজে সুবিধা। কিন্তু দোকানেরই তো ঠিকঠিকানা নাই, এইসব টানাটানির লাভই তো দেখি না। এসময় হেসে উঠেন পরামর্শদাতারা।
অন্য কিছু করা হয় কি-না- জানতে চাইলে রাকিব জানায়, সে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, রোল নম্বর ৪৮। তার বাবা আজগর মিয়া, মা রাশিদা বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে-ই বড়।
দোকান পরিচালনা করে পড়াশোনায় সমস্যা হয় না?- প্রশ্ন করতেই রাকিবের মুখ থেকে তেজীভাব সম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী উত্তর- জ্যামের দোকানদারি করলে কোনো ক্ষতি হয় না। আর আমি তো সবসময় দোকানে বই না। আব্বায় বহে। দোকান না থাকলে আব্বায় অটো-রিকশা (ব্যাটারি চালিত) চালায়। আমি টানি মাইঝে মাইঝে। জ্যামের দোকানে বিক্রি কেমন- প্রশ্নে শীত বস্ত্রহীন রাকিবের উত্তর- এইটার ঠিক নাই। কোনো সময় ৫০০ আবার এক হাজার। সারারাইত থাকতে পারলে ২ হাজারও হয়।
এসময় যশোরগামী একজন যাত্রী রাকিবের চায়ের প্রশংসা করতে থাকে। কিন্তু পাল্টা উত্তরে রাকিব জানিয়ে দেয়- এইসব কইয়েন না। ফেরিঘাটের চা যে কদ্দুর ভালা, আমরা ভালই জানি। এইসব তো গরম পানি। যাত্রী কৌতুকের সুরে বলে উঠে- গরম পানি খাওয়াও তো দাম নেও কেন। রাকিবও জানিয়ে দেয়- কেরাসিন কিন্না আগুন জ্বালাই। এই আগুন দিয়া পানি গরম করি তো, হের লাইগ্গা দাম লই।
এসময় রাকিবের কথার প্রশংসা করতে থাকেন অনেকেই। দু’একজনের মুখ থেকে শোনা যায়- ছেলেটা ভাল, সরল, বড় হলে ভাল ব্যবসাই করতে পারবে। ভোর ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত রাকিবের জ্যামের দোকানের সামনে অবস্থান ছিল আমাদের সময় ডটকমের। ততক্ষণে শুক্রবারের সূর্য উঁকি দিয়ে ফেলে। রাকিবের পেছনে থাকা সরিষা বোনা মাঠ স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই মাঠ পেরুলেই রাকিবের বাড়ি। সকাল ৭টার দিকে রাকিব বলে উঠে- বহুত বেচছি আর বেচুম না। রাইতে আবার জ্যাম লাগব। তহনই আবার আমু। বলেই রাকিব দোকান গুছিয়ে ফেলতে থাকে বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম