টুঙ্গিপাড়ার মন্দিরে ভাঙচুর হিন্দু-মুসলমান পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
রিকু আমির, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে: টুঙ্গিপাড়ার বড় ডুমুরিয়ার জামাই বাজার এলাকায় তিনটি সার্বজনীন মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। হিন্দুরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করলেও মুসলমানদের কেউ আড়ালে, কেউবা গল্পচ্ছলে অভিযোগ করছেন হিন্দুদের বিরুদ্ধে।
হিন্দুরা অভিযোগ করছেন, মন্দিরের দেড়শ ফুট দূরত্বে নবনির্মিত সøুইস গেট ঘেঁষা সরকারি জমি দখল কেন্দ্র করে বাঁশবাড়িয়ার বাসিন্দা সিরাজ শেখ ও ইজাজ শেখ তাদের লোকজন দিয়ে মন্দিরে ভাঙচুর চালায়। তাদের সহযোগিতা করেন সøুইস গেট নির্মাণের ঠিকাদার আমিনুলের সহযোগী সোহেল। এরই মধ্যে ভাঙচুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে সোহেলকে।
অন্যদিকে, লোকমুখ থেকে বড় ডুমুরিয়া গ্রামের আশপাশ গ্রামের মুসলিমদের মধ্যে জোর ধারণা জন্মেছে- সব ঘটনা ঘটিয়েছে হিন্দুরাই। হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা দিয়েছে, মসজিদ ভেঙে ফেলেছে- এসব থেকে নিজেরা রক্ষা পেতে নিজেরাই মন্দির ভেঙে মুসলমানদের উপর দোষ চাপানো হচ্ছে। এসব কথা ছড়িয়ে পড়েছে গোপালগঞ্জের বেশকিছু উপজেলায় বলে তথ্য আছে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির কাছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সøুইস গেট নির্মাণ কাজে সুবিধার জন্য এ স্থানে থাকা ১০টি দোকান শান্তিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ করেন ঠিকাদার আমিনুল। সব দোকানের মালিক ছিল হিন্দু। মৌখিক শর্ত ছিল- কাজ শেষ হলে যার যার স্থানে সে সে দোকান করবেন। আজ থেকে ছয় মাস আগে বিশ্রাম গ্রহণের উদ্দেশে সে স্থানে গোলপাতা দিয়ে গোলাকৃতির ছোট্ট ঘর তোলেন আমিনুল। এর মধ্যে নির্মাণ শ্রমিকদের কেউ কেউ ও স্থানীয় কিছু মুসলিম ব্যক্তি নামাজও আদায় করতেন। একটি সময় এ জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণ করতে যান বাঁশবাড়িয়ার বাসিন্দার সিরাজ শেখ ও ইজাজ শেখ। তখনই উত্তেজনা বাড়ে হিন্দুদের সঙ্গে।
এসব নিয়ে গতকাল রোববার দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে ‘টুঙ্গিপাড়ার মন্দিরে ভাঙচুরের আশঙ্কা সৃষ্টি হয় গোলপাতা দিয়ে নির্মাণ করা ঘর থেকে’ শীর্ষক শিরোনামে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শুক্রবার এ প্রতিবেদক গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন্স, লঞ্চঘাট হয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এ প্রতিবেদকের কাছে স্থানটি সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়ায় পাটগাতি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে ব্যাটারি চালিত অটো রিকশাচালক রমজানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। বলা হয়- জামাই বাজারের কাছে যে মন্দির ভাঙা হয়েছে, সেখানে কীভাবে যাব? চট করে রমজান কৌতূহলী দৃষ্টিতে এ প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে বলেন, কী করবেন স্যার? আপনে প্রশাসনের কেউ?
সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি একটু নিচু স্বরে বলেন, ‘ভালো কইরা খোঁজ নিয়ে লেইখেন। হুনছি, হিন্দুরা বলে মসজিদ ভাইঙ্গা ফালাইছিল। এরপরে মুসলমানরা বলে জিদ কইরা মন্দির ভাংছে।’ আপনার কী মনে হয়- কাজটা ঠিক হইছে- রমজানকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘যেমনে ঘটনা হুনছি, হেমনে হইলে তো ঠিকই আছে। আমাগো মসজিদ ভাঙব কেন হিন্দুরা?’
রমজানের সহযোগিতা নিয়ে পাটগাতি বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি সিএনজি গ্যাসচালিত অটোরিকশায় চড়েন এ প্রতিবেদক। প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাঁশগাড়ি ছিল গন্তব্য। সেখানে পৌঁছার ফাঁকে কথা হয়- সিএনজি গ্যাসচালিত অটোরিকশা চালক মঞ্জুরের সঙ্গে। ‘জামাই বাজারের কাছে যে মন্দির ভাইঙ্গা লাইছে, সেইখানে কেমনে যামু’- প্রশ্ন করতেই মঞ্জুর কিছুটা ভীত দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকান এ প্রতিবেদকের দিকে। এরপর বলেন, কী করবেন। এ প্রতিবেদক উত্তর দেন- থাকি তো গোপালগঞ্জ সদরে, আসলাম দেখতে, শুইনা খারাপ লাগছে।
মঞ্জুর জানতে চান এ প্রতিবেদক মুসলিম নাকি হিন্দু। মুসলিম বলার পর তিনি একটু জোরালো স্বরে বলেন, মুসলিম হইয়া আপনি হিন্দুগোরে দেখাতে যাইতাছেন? জানেন হেরা কী করছে?
এ প্রতিবেদক বলেন, না, কী করছে। মঞ্জুর বলেন, হেরা নিজেরাই মন্দির ভাঙছে, দোষ দিতাছে মুসলমানের উপরে, এইটা গেরামের সবাই জানে। কিন্তু প্রশাসন তো হিন্দুগো পক্ষেই কাম করতাছে। এইটা কী ঠিক? এ প্রতিবেদক উত্তর দেন- এরকম হইলে তো ঠিক না। আচ্ছা, আপনে কইত্তে শুনলেন, হিন্দুরাই মন্দির ভাংছে? কী কারণে ভাংছে?
মঞ্জুরের উত্তর- ওই কালকা বাঁশবাড়িয়া বাজারে গাড়ি লইয়া খারাইয়া আছিলাম। তখন হুনছি লোকজন বলাবলি করতাছিল। কী জন্যি ভাংছে তা ঠিক শুনবার পারি নাই। প্যাসেঞ্জার লইয়া চইলে আইছিলাম।
এ প্রতিবেদক বলেন, এইটা তো মিথ্যাও হইতে পারে। আপনে যাচাই না কইরাই হিন্দুদের দোষ দিলেন? মঞ্জুর বলেন, এতো টাইম কই। তয় হিন্দুরা যে খারাপ এইটা ঠিকই। তার বাড়ি বাঁশবাড়িয়াতেই। তিনি এ প্রতিবেদককে এ গ্রামের বাজারে নামিয়ে দেন। এ বাজারে নেমে ৬/৭টি চা দোকান, সবজি বাজার ও একটি মসজিদে যান এ প্রতিবেদক। একটি চা দোকানে চা পানের সময় একজন বৃদ্ধা এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। এনজিও কর্মী পরিচয় দিয়ে জানতে চাওয়া হয়- টাকা-পয়সা দিতে যাব জামাই বাজারের মন্দিরে। ওখানে কেমনে যাব?
যাওয়ার উপায় বর্ণনা শেষে জহির নামের ব্যক্তি একটু রূঢ়তার সঙ্গে বলেন, হেরাই তো ভাংছে, আবার হেগোরেই টেকা দিবেন? ভাইঙ্গা আমগো মুসলমান গো উপরে দোষ চাপাইছে। যান, যান, আইছেন তো দালালি করতে। গত বুধবার ভাঙচুরের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত সিরাজ শেখ ও ইজাজ শেখের বাড়ি এই বাঁশবাড়িয়াতেই।
জহিরের সঙ্গে কথা শেষে একটি পাকা সেতু হেঁটে পার হয়ে একটি মোটরচালিত ভ্যানগাড়ি ভাড়া করে জামাই বাজারের উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়া হয়। মন্টু নামের ভ্যানচালকের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। পথে একটি চা দোকানে দাঁড়িয়ে প্রায় ১৫ মিনিট তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি তো আর দেখি নাই। শুনছি। শুনছি, হিন্দুরা বলে মসজিদ ভাইঙ্গা খালের মইদ্যে জায়নামাজ ফালাইয়া দিছে। এই জিদে মুসলমানরা মন্দির ভাংছে।
মন্টুকে প্রশ্ন করা হয়, কাজটা কী ঠিক হইছে? মন্টু বলেন, আমি কেমনে কমু। তয় যা হুনছি, হিন্দুরা মসজিদ ভাংলো কেন? মুসলমানরা তো হেগো কোনো ক্ষতি করে নাই।
পানি পানের জন্য জামাই বাজার থেকে সামান্য দূরে একটি বসত বাড়িতে প্রবেশ করেন এ প্রতিবেদক। অনুরোধ জানালে একজন তরুণী এ প্রতিবেদককে দুই গ্লাস পানি পান করান। পানি পানের ফাঁকে মন্দিরের অবস্থান সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। উত্তর দেওয়ার পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- ঘটনা কী, জানেন নাকি কিছু।
রেশমা (ছদ্মনাম) নামের এই তরুণী প্রথমে অস্বীকার করেন কিছুই জানেন না বলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ তার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠার পর বলেন, সব কথা তো বলতে ভয় করে। কোনো ভয় নেই, আমি পুলিশের কেউ না, বলেন, একটু শুনি- এ কথা বলে তাকে আশ্বস্ত করার পর বলেন, ওই শুনছি আরকি, হিন্দুরা বলে মসজিদ ভাইঙ্গা ফালাইছে, এইজন্য নাকি মুসলমানরা মন্দির ভাংছে।
রেশমাকে প্রশ্ন করা হয়- এই কথা কী আপনার বিশ্বাস হয়? তিনি বলেন, বিশ্বাস কী হয়? হিন্দুরা মসজিদ ভাংব এইটা তো বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বা চক্রান্ত আছে। এরপর এ প্রতিবেদক মন্টুর ভ্যানে চড়ে পৌঁছে যান জামাই বাজার সংলগ্ন সার্বজনীন মন্দিরে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধের কাছে একজন চা বিক্রেতা, নাম শাহাজাদা, তার সঙ্গে কথা হয় ঘটনাটি নিয়ে। তার কথা অবিকল মন্টুর মতো। সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও রোববার সকাল-দুপুর পাটগাতি, বাঁশবাড়িয়াসহ আরও কিছু এলাকায় মুসলিম ব্যক্তিদের সঙ্গেও কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যেকের বক্তব্য হিন্দুদের উল্টো। হিন্দুদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে- হিন্দুরা নাকি মসজিদ নির্মাণে বাধা দিচ্ছে- এমন কথা সিরাজ ও ইজাজ প্রচার করে আশপাশের মুসলিম গ্রামবাসীদের উত্তেজিত করে।
অভিযোগ আরও- ইজাজ ও সিরাজ দফায় দফায় হিন্দু ও প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া বাধায় মসজিদ নির্মাণে ব্যর্থ হবেন- এটা নিশ্চিত জেনে, বিশেষ করে গত সোমবার গোলপাতার ঘরে থাকা জায়নামাজ ফেলে দেওয়ার পাশপাশি ঘরে থাকা অন্য সরঞ্জাম ফেলে দেওয়ার জের ধরে গত বুধবার রাতে মন্দিরে ভাঙচুর চালায়। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বড় ডুমুরিয়া গ্রাম ছিল উত্তেজনায় ভরা।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসু বলেন, গোলপাতার ঘরটি তুলতে পেরেছে বলেই সেখানে নামাজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছে ও মসজিদ নির্মাণের অজুহাত দেখাতে পেরেছে সিরাজ ও ইজাজ। আসলে তাদের উদ্দেশ্য- মসজিদ নির্মাণ নয়। জায়গা দখল না করতে পেরে তারা মসজিদ হাজির করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার অপকৌশল প্রয়োগ করে। এ ঘটনা নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গুজবও রটিয়েছে। আমাদের অভিযোগ শুধু এ দুজন ও যারা ভাঙচুর করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই। অন্য মুসলমান সম্পর্কে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। নেতৃস্থানীয় কোনো মুসলিম ব্যক্তি হিন্দুদের বিষয়ে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য বা অভিযোগ করতে রাজি নন। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম