কেমন ছিল জনকের স্বদেশে ফেরার সেই দিনটি?
রবিউল আলম
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেদিন কি বার ছিল স্মরণে নেই, সকাল থেকেই বাংলার মানুষ বাঁধভাঙা আনন্দে আত্মহারা, দূর-দূরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল, পাড়ায়-মহল্লায় আনন্দের সীমা নেই। মানুষ ভুলে গেছে ৯ মাসের সংগ্রামে মা হারা, পিতা হারা, স্বজন হারানোর ব্যথা। প্রতিটি মানুষের মুখে একটি কথাইÑ কখন আসবে জাতির জনক, কখন এক নজর দেখতে পাবে বাঙালির প্রিয় মানুষটিকে, কেমন হয়েছে তার মুখখানি ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকে, কেমন অত্যাচার হয়েছিল আমাদের জাতির জনকের উপর?
জনগণ একে অন্যের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করছিল, আবেগে আত্মহারা হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের দলীয় নেতা-কর্মী, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনকের পিতা-মাতা, বেগম মুজিব, জাতীয় চার নেতাসহ অগণিত মানুষের উস্থিতিতে বিকেলে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান বাংলার মাটি স্পর্শ করল, তখন হৃদয়বিদারক সেøাগানে সেøাগানে কম্পিত হয়ে উঠল পুরাতন বিমান বন্দর। একদিকে আনন্দের বন্যা, অন্যদিকে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল মানুষ। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল বিমানবন্দর, সারি সারি গাড়ির বহর নিয়ে খোলা জিপে জাতির জনক রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষের চিৎকার, হাতে ফুলের পাপড়ি, মুখে সেøাগানÑ জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি।
এগিয়ে চলেছে জাতির জনককে বহনকারী গাড়ির বহর, অনেক বাধা-বিপত্তি ও লাখো মানুষকে পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে মঞ্চে উঠে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাতির জনক। হৃদয়বিদারক চিৎকার ও সেøাগান, মাঝে মাঝে গান জয় বাংলা, বাংলার জয় সহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ও দেশাত্মবোধক গান বাজতে থাকে। বঙ্গবন্ধু তার চিরাচরিত ভাষায় বলে উঠলেন, ‘ভাই ও বোনেরা, সাত কোটি বাঙালির উপর যে নিদারুণ অত্যাচার হয়েছে তা আপনারা জানেন। দুনিয়ার কোনো দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে এত মানুষের জীবন যায়নি, যা আমার সোনার বাংলার উপর দিয়ে চলে গেছে। ৩০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এক কোটি মানুষ মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আমি চেয়েছিলাম বাংলার মানুষের বাঁচার অধিকার, বিনিময়ে তারা আমার মানুষের উপর চালিয়েছে বন্দুকের গুলি।’
এই ভাষণ এখনো আমরা রেডিও, টেলিভিশনে শুনতে পাই। কিন্তু সেদিনের ১০ জানুয়ারিতে যারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত ছিলেন শুধু তারাই বলতে পারবেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৫ বছরের মধ্যে আর একটি গণজমায়েতও কি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সমকক্ষ হয়েছিল? হয়নি। তা হওয়া তো দূরের কথা, তার ধারে কাছেও আসতে পারেনি। স্মৃতির পাতায় আজও সেই স্মৃতি অম্লান। সেদিন দেখেছি, মানুষ যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, খাওয়া-দাওয়া, প্রাকৃতিক ডাক, স্বাভাবিক জীবন যেন কারও কাছেই ছিল না, মানুষ যেন একটি প্রাণের মাঝেই আবদ্ধ হয়ে আছে। প্রতিটি চোখ শুধু একটি মানুষকে দেখতে চাইছে, জাতির জনকের প্রতি সবাই আবদ্ধ হয়ে আছে। সেই আনন্দ বেদনার স্মৃতিচারণ আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এত বড় একজন মহামানব, এত বিশাল গণজমায়েত, স্বজনহারা মানুষের কান্না, ৯ মাসের সংগ্রাম ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। আমি তখন মাত্র ১৪ বছরের একজন কিশোর, এখনকার মতো তখন এত পরিবহন ছিল না। তৎকালীন সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম নাসির উল্লাহ ও রমিজ ভাইয়ের নেতৃত্বে বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মো. সাদেক খান ও তার বড় ভাই নাদের খান, রশিদ চাচা, গফুর ভাই, বাচ্চু ভাই, বুলবুলসহ অনেকেই বিমানবন্দর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিছিল নিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে।
সারাদিন আনন্দে কাটলেও বিকালে পেটের টানে আর চলতে পারছিলাম না। এত মানুষের খাওয়ার মতো হোটেল অথবা মুড়ি-চিড়া কিছুই ছিল না। শুধু একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। তবু আনন্দের যেন শেষ, ফিরেছেন আমাদের জাতির জনক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। না বলে মিছিলে যাওয়ার অপরাধে মায়ের বকুনি ও বাবার মার ছিল আমার উপহার। অবশেষে দাদার বদৌলতে রাতের খাবার জুটেছিল।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে, ৪৫ বছর পরে সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হবে ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে এবং আলহাজ্ব সাদেক খানের নেতৃত্বে। কিন্তু সে আনন্দ, বেদনা, জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কিছুই থাকবে না, বুকের মাঝে শুধু হাহাকার নিয়ে ফিরে আসতে হবে জমায়েত শেষে। তবুও ১০ জানুয়ারি পালন করছি আমাদের ঐক্যের জন্য।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান