বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধু যখন দেশের মাটিতে পা দিলেন, তখন বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হলো
আশিক রহমান: ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরেছিলেন। একসময় বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়া যাবে এই সম্ভাবনা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় পেলাম। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলো। কিন্তু আমাদের একটি অপ্রাপ্তির বেদনাও ছিল তখন, সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে না পাওয়াÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে আমরা জীবিত ফিরে পেয়েছি, এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় তাৎপর্য এবং একটি বড় মাত্রা। তবে বঙ্গবন্ধু যদি দেশে ফিরতে না পারতেন কি পরিণতি হতো বাংলাদেশের সেটি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল সেই সময়। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে স্বাধীন দেশের মাটিতে যখন পা দিলেন, তখন বাংলাদেশটি একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হলো। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি বাঙালির স্বপ্নসাধকে বাস্তবায়নের জন্য সারাজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি যথার্থ একজন নেতা ছিলেন। শুধু নেতাই নয়, রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। কিন্তু তার শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। পঁচাত্তরের ঘটনার পর বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়। এখন হয়তো বাংলাদেশ কিছুটা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন, স্বাভাবিক আয়ু পেতেন, তাহলে আজকের বাংলাদেশ অন্যরকম হতো। অন্য উচ্চতায় তার অবস্থান থাকত।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা থেকে আমরা কিছুটা বিচ্যুত হয়েছি। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ দুটিই একটি আদর্শ রাষ্ট্রের পরিপন্থী। উপরন্তু রাষ্ট্রের সংবিধানে যখন রাষ্ট্রধর্মের বিধান থাকে, তখন সে রাষ্ট্রটি অনিবার্যভাবে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হয়ে যায়। এটাও বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা থেকে বিচ্যুতি বলে আমি মনে করি। তবে নানাদিক থেকেই বাংলাদেশ এগোচ্ছে। হয়তো রাতারাতি সবকিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, তবে সঠিক পথেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত বাংলাদেশ এগোচ্ছে কি না সেটি নিয়েই আমাদের সংশয় রয়েছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তেমনটিই ইংগিত দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া একসময় বলেছিলেন, আমার উপর চাপ আছে জেনারেলদের পক্ষ থেকে। মুজিবের বিচার হবে, ফাঁসিও দেওয়া হবে। এমনকি শেষ মুহূর্তে ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময়ও শেষ অনুরোধ করেছিলেন, যেন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু ভুট্টো তাকে ফাঁসি দেননি। কারণ ৯৩০০০ হাজার পাকিস্তানি সৈনিক তখন বাংলাদেশে বন্দী। তাদের ব্যাপারে লেনদেন করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে প্রয়োজন ছিল।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক চাপও ছিল তখন যেন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি না দেওয়া হয়। যেকোনো কারণেই হোক বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি বা হত্যা করতে পারেনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার। কিন্তু সেই কাজটিই করেছি আমরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে ঠিকই কিন্তু এর পিছনে পাকিস্তানি যোগসাজশ যে ছিল সেটা প্রমাণিত সত্য, এ বিষয়ে তথ্য আমরা জানি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, বিচারের দ- কার্যকর করা হয়েছে। পলাতক খুনিরা এখনো বিদেশে, তাদের ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখটি হচ্ছেÑ বাঙালি বাঙালির নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। এটি বাঙালির জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্কজনক। হত্যার বিচার হোক, দ- যতই কার্যকর করা হোক না কেন, এই কলঙ্ক কোনোদিন মুছবার নয়। সম্পাদনা: এনামুল হক