নানা প্রশ্নের জালে আবৃত টুঙ্গিপাড়ার ৩ মন্দিরে ভাংচুর
রিকু আমির, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে : নানা প্রশ্নের জালে আবৃত টুঙ্গিপাড়ার বড় ডুমুরিয়ার জামাই বাজার এলাকায় এক ছাদের নিচে অবস্থিত তিনটি সার্বজনীন মন্দির ভাংচুরের ঘটনা। গত বুধবার গভীর রাতে ভাংচুর হবার পর থেকে এ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানরা প্রকাশ্যে ও আড়ালে পাল্টাপাল্টি দোষারোপেই ব্যস্ত। হিন্দুরা বলছেন, জায়গা দখলের জন্য মসজিদ নির্মাণের অজুহাত সৃষ্টি করেও তা নির্মাণে বাধা পাওয়ায় মুসলমানরা দেবদেবী ভেঙেছে। মুসলমানরা বলছেন, মুসলমানদের ফাঁসাতে মন্দির ভাংচুরের ঘটনা হিন্দুরাই সাজিয়েছে। হিন্দুদের স্বার্থÑ হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে মুসলমানের ছিটেফোটাও তারা রাখবে না। দৈনিক আমাদের অর্থনীতির অনুসন্ধানে দেখা যায়Ñ বেশকিছু কারণে মন্দির ভাংচুর রহস্যের জালে ঘিরে আছে। ভাংচুর নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনদিন পূর্বে যেসব হিন্দু ব্যক্তি সোজাসাপ্টা কথা বলতেন, তারা এখন কাচুমাচু করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জামাই বাজারের দক্ষিণ দিকের ভাটিতে ৮ শতাংশ জায়গা জুড়ে মন্দিরগুলোর সীমানা। এক ছাদের নিচে দুর্গা, হরি ও রাধা-কৃষ্ণ মন্দির। মন্দিরে প্রবেশ গেট দুটো,
দুটোই কলাপসিবল। একটি পশ্চিমে ও আরেকটি পূর্ব দিকে। মন্দিরটির সম্মুখভাগ পড়েছে দক্ষিণ দিকে। এ প্রতিবেদককে দেয়া মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসুর ভাষ্যমতে, প্রতিদিনের মতো সেই রাতেও মন্দিরের দুটো কলাপসিবল গেট তালাবদ্ধ ছিল। দুটোতেই মাঝারি আকৃতির তালা। পশ্চিমের গেটে ছিল নিম্নমানের মাঝারি আকৃতির চাইনিজ তালা ও পূর্বের গেটে মাঝারি আকৃতির মজবুত, স্টিলের কোরিয়ান তালা। সরেজমিনে জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা ভেঙেছিল পশ্চিমের গেটের তালা। এ প্রতিবেদককে এ কথা বলেছেন নিরাপদ বসুও। তবে ভেঙে ফেলা তালা তিনি এ প্রতিবেদককে দেখাতে পারেননি বা বলতেও পারেননি এ তালা কোথায়, মামলার আলামত হিসেবে পুলিশের কাছেও ভাঙা তালার অস্তিত্ব নেই। আর গেটের দুই অংশকে গোলাকৃতির যে দুই অংশ দিয়ে তালাবদ্ধ করা হয়, সেখানে কোনো চিহ্নও নেই, এ প্রতিবেদক চিহ্ন দেখতেও পাননি। এটি নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য আছে স্থানীয়ভাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্গামন্দিরে থাকা দেবদেবীগুলোর মধ্যে দুর্গা, লক্ষ্মী, স্বরস্বতী দেবীর মাথা ভেঙে যার যার গলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়। সেসব স্ব স্ব দেবীর গলায় সামঞ্জস্যহীনভাবেও ঝুলে আছে। গণেশ, রাবণ ও কার্তিকের মাথা মেঝেতে পড়ে আছে। গণেশ, কার্তিকের মাথা তাদের খুবই কাছে, তিন হাতের মধ্যে ও রাবণের মাথা প্রতিমা থেকে প্রায় দশ হাত দূরে পড়ে আছে।
দূর্গামন্দির ঘেঁষা পশ্চিম দিকে হরিমন্দিরের অবস্থান। সেখানে হরিমাধবের মাথার ভগ্নাংশ পড়ে আছে। মাথাটি হরিমাধব থেকে ৫ হাত দূরে। আর বসে থাকা হরিমাধবের দেহ পূর্ব দিকে হেলে আছে। হরিমাধবের স্ত্রী শান্তি মাতার ডান হাত ভাঙ্গা। শান্তি মাতাকে মন্দিরে প্রবেশের সিড়ির গোড়া থেকে বুধবার ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে উদ্ধার করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয় বলে এ প্রতিবেদককে জানান মুক্তিযোদ্ধা প্রফুল্ল এর একমাত্র ছেলে বিপ্লব।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, মন্দিরের ভেতর পূজার প্রায় সব ধরনের সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব সরঞ্জামের মধ্যে আছে ধাতব সরঞ্জামও। এছাড়া চারটি বড় ঢাকের এক পাশে সর্বোচ্চ এক বিঘত আঘাতের চিহ্ন আছে, যাতে চামড়া দিয়ে নির্মিত ঢাকের পর্দা ফেটে গেছে। বাকি দুই ঢাক অক্ষত। এছাড়া খঞ্জনি, ঝনঝনি, করতালসহ আরও কিছু হালকা গোছের বাদ্যযন্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে।
এ প্রতিবেদক মন্দিরের সীমানা থেকে সবচেয়ে কাছে, মাত্র ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ গজ দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত দুটি বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে জানতে চায়Ñ তালা ভাঙ্গা, দেবদেবী, বাদ্যযন্ত্র, পূজার সরঞ্জাম ভাংচুরের সময় তারা টের পেয়েছিলেন কি-না, তারা কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর প্রথমে জানতে চাওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রফুল্ল এর বাড়িতে। তার ছেলে বিপ্লব সোমবার দুপুরে জানান, তারা ঘুমিয়েছিলেন। কিছুই টের পাননি। মন্দিরের সেবায়েত কমলা রায়ের আর্তচিৎকারে তাদের ঘুম ভাঙে। এরপর বেরিয়ে মন্দিরের সামনে অন্তত ১০০ গ্রামবাসী দেখার পাশাপাশি দেখেন- গেট খোলা, দেবদেবী, পূজার সরঞ্জাম ও বাদ্যযন্ত্র ভাংচুর করা। তিনি গেটের কোনো ভাঙা তালা দেখতে পাননি বলে জানান। পিতামাতাসহ তার ঘরে সেই রাতে ঘুমিয়ে থাকা মোট সাতজনের কেউ-ই ভাংচুরের কোনো শব্দ পাননি বলেও জানান বিপ্লব।
প্রফুল্ল ম-লের ঘরের দক্ষিণ দিকে পড়েছেÑ গোবিন্দ ম-লের চারচালা ঘর। এ ঘর থেকে মন্দিরের দূরত্ব ৫০ থেকে ৬০ গজের মধ্যে। গোবিন্দ তার স্ত্রীসন্তানসহ এ ঘরে থাকেন। তিনিও নাকি সে রাতে কিচ্ছু টের পাননি। গ্রামবাসীর শোরগলে তার ও তার পরিবারের ঘুম ভাঙে। বেরিয়ে দেখতে পান বিপ্লবের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী দৃশ্য।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসুর কাছে এ প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিলÑ মাটিতে দেবদেবীর মাথা অন্তত ৫-৬ হাত উপর থেকে পড়েছে। এসব বড় আকৃতির ও ভারী। তাছাড়া বাদ্যযন্ত্র ভেঙেছে, পূজার সরঞ্জাম ভেঙে তছনছ করেছে, এসব সরঞ্জামের মধ্যে স্টিল, পিতল, তামার সরঞ্জামও ছিল। এসব জিনিসপত্র ভাংচুর করা হলে শব্দ হবার কথা স্বাভাবিকভাবেই। কিন্ত মন্দিরের খুব কাছের দুটো ঘরের বাসিন্দারা কোনো শব্দই নাকি পাননি। এটা কেমন বা কী?
উত্তরে নিরাপদ বসু এ প্রতিবেদককে টুঙ্গিপাড়ায় গত কয়েকদিন ধরে চলমান তীব্র শীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, শীতের রাত্র তো, মানুষজন আরাম করে ঘুমিয়ে ছিল। এজন্য টের পায়নি কেউ।
মন্দিরের সেবায়েত কমলা রায়কে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। সেদিন ভোর রাতে তিনি কিছুটা দূরবর্তী প্রতিবেশি চিত্ত হাওলাদারের মাধ্যমে জানতে পারেন, মন্দিরে ভাংচুর হয়েছে। তখন তিনি চিৎকার করতে করতে দৌড়ে মন্দিরে যান এবং দেখতে পান বিপ্লব যেমন দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন, তেমন দৃশ্য। কমলা আরও জানান, চিত্ত তার বাড়িতে এসে মন্দির ভাংচুরের খবর দিয়েছিলেন এবং তখন নাকি চিত্ত তাকে প্রশ্নও করেছিলেন, মন্দিরের গেট তো খোলা, কমলা গেট তালা দিয়েছিলেন কি-না। এ কথা শুনে কমলার মনে সন্দেহ প্রবেশ করে। তিনি কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েন। তবে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানান, সে রাতে তিনি মন্দিরের গেট নিজ হাতে তালাবদ্ধ করেছিলেন। সম্পাদনা: শারমিন আজাদ