বিরোধপূর্ণ স্থানে ফের বসানো দোকান উচ্ছেদ, হয়রানিমূলক গ্রেফতার বন্ধে মীমাংসা হতে পারে টুঙ্গিপাড়ার তিন মন্দিরে ভাঙচুরে ‘তালা-চাবি ধোঁয়াশা’
রিকু আমির, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে: টুঙ্গিপাড়ার বড় ডুমুরিয়া জামাইবাজার এলাকার তিনটি সার্বজনীন মন্দিরের যে একটি কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙে কিছু দেব দেবীসহ বাদ্যযন্ত্র, পূজার সরঞ্জাম ভাঙচুরের কথা বলা হচ্ছে, সেই একটি গেটের তালা-চাবি নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা বেরিয়ে এসেছে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির অনুসন্ধানে।
গত বুধবার গভীর রাতে এক ছাদের নিচে অবস্থিত দুর্গা, মাধব ও রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে- তালা ভেঙে দুর্বৃত্তরা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ৮ শতাংশ স্থান জুড়ে মন্দিরের সীমানা। মন্দিরটির আঙিনা দক্ষিণমুখী। চতুর্দিক পাকা করে নির্মিত মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতে হয় দুটো কলাপসিবল গেট দিয়ে। একটি পূর্ব দিকে ও আরেকটি পশ্চিম দিকে। পশ্চিম গেটের আকার কিছুটা ছোট পূর্বের গেট থেকে।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ প্রতিবেদককে বলছেন- দুটো গেটই তালাবদ্ধ ছিল বুধবার রাতে। পশ্চিম গেটে ছিল পূর্ব গেটের তালার চেয়ে দুর্বল গোছের মধ্যম আকৃতির চায়না তালা। পূর্ব গেটে মধ্যম আকৃতির মজবুত ও স্টিলের কোরিয়ান তালা। দুর্বৃত্তরা চায়না তালা ভেঙে মন্দিরে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায়।
যদিও ঘটনার আলামত হিসেবে পুলিশের কাছে ভাঙা তালা বা এর কোনো অংশ নেই। ‘’দেখিনি’’ ছাড়া নিরাপদ বসুসহ মন্দিরের সেবায়েত কমলা রায়ও বলতে পারছেন না ভাঙা তালার বিষয়ে আর কিছু। স্থানীয় অন্য বেশকিছু প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যও- দেখিনি ভাঙা তালা।
তালা ভাঙা, দেবদেবী ভাঙচুর, পূজার সরঞ্জাম ভাঙচুরের কোনো শব্দও ঘটনার রাতে পাননি মন্দিরের আনুমানিক মাত্র ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ গজ দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত দুটি বাড়ি, গোবিন্দ ম-ল ও প্রফুল্ল ম-লের বাড়ির লোকজন।
আর গেটের দুই অংশকে গোলাকৃতির যে দুই অংশ দিয়ে তালাবদ্ধ করা হয়, সেখানে কোনো চিহ্নও নেই, এ প্রতিবেদকও কোনো অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখাতে পাননি।
এ প্রতিবেদকের কাছে তথ্য ছিল- সে রাতে যে গেটের তালা ভাঙার কথা বলা হচ্ছে, তাতে তালা ছিল না। তথ্যানুসন্ধান করতে এ প্রতিবেদক কথা বলেন মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসু, সেবায়েত কমলা রায়সহ স্থানীয় আরও একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সঙ্গে।
তাদের প্রত্যেকের কাছে এ প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল- তালা কবে কেনা হয়েছে, দুটো তালা একসঙ্গে নাকি আলাদা কেনা হয়েছে, দুটো তালার চাবি কয়টি, চাবিগুলো কার কার কাছে থাকে, ঘটনার দিন রাতে সেই তালা লাগানো ছিল কি-না।
সেবায়েত কমলা রায় এ প্রতিবেদককে জানান, দুটো তালাই গত দুর্গা পূজার সময় ৭০০ টাকা দিয়া কেনা হয়েছিল। পশ্চিম গেটের তালার চাবি (চায়না) তার কাছে একটিও নেই। তার কাছে আছে-পূর্ব গেটের(কোরিয়ান তালা) একটি চাবি। আর কারও কাছে কোনো চাবি আছে কি-না তিনি জানেন না।
নিরাপদ বসু বলেন, চায়না তালা কেনা হয়েছিল বছর খানেক আগে। এর চাবি ছিল তিনটি। একটি হারিয়ে গেছে অনেকদিন আগে। এটি কার কাছে ছিল তিনি মনে করতে পারেননি। আরেকটি চাবি আছে মন্দির কমিটির সাবেক সভাপতি বিমল বিশ্বাসের কাছে, আরেকটি চাবি জামাই বাজারের ব্যবসায়ী ও মন্দির এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা নিমাই গাইনের কাছে। দুটো চাবি বর্তমানে যে দুই ব্যক্তির কাছে আছে তার সত্যতা পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। হারিয়ে যাওয়া চাবি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
নিরাপদ জানান, কোরিয়ান তালার চাবি তিনটি। এসব কমলা, নিরাপদ ও মন্দির কমিটির ক্যাশিয়ার শিপনের কাছে। এসবের সত্যতা পেয়েছেন এ প্রতিবেদক।
ঘটনার রাতে মন্দিরের গেট তালাবদ্ধ থাকা, না থাকা নিয়ে কমলা রায় এ প্রতিবেদককে জানান, সেদিন সন্ধ্যা থেকে কীর্তন চলছিল মন্দিরের ভেতরে। তিনি সন্ধ্যায় দেখেন বাড়িতে যান। আবার আসেন রাত আটটার দিকে। তখন দেখতে পান- পূর্বের গেটের কোরিয়ান তালা লাগানো, পশ্চিমের গেটে (চায়না তালা) খোলা। ভেতরে তখনও সন্ধ্যার চেয়ে কম মানুষের জমায়েতে কীর্তন চলছিল। এরপর তিনি বাড়ি চলে যান। আর আসেননি সে রাতে। ভোরে মন্দির ভাঙচুরের খবর পেয়ে তিনি আসেন।
এ প্রসঙ্গে নিরাপদ বসু বলেন, আমার বাড়ি এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে। বিশেষ কারণ ছাড়া আমি সন্ধ্যা বা রাতে মন্দির প্রাঙ্গণে থাকি না। সেদিনও ছিলাম না। শুনেছি- কীর্তন চলছিল ঠিকই। কিন্তু ৮টার দিকে কীর্তন শেষ হবার পর দুটো গেটই তালাবদ্ধ ছিল।
কমলা এ প্রতিবেদককে যা বলেছেন, তা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমি তো কমলার কাছ থেকে শুনেছি, সে রাতে দুটো গেটই তালাবদ্ধ ছিল। তিনি নাকি দেখে গেছেন নিজে।
আবার এ বিষয়ে কমলাকে প্রশ্ন করা হলে প্রথমে জানান, পশ্চিমের গেট খোলা ছিল, তখন ভেতরে কিছু লোক কীর্তনরত ছিল, তারা এ গ্রামেরই পরিচিত মুখ। এসব তথ্য দেবার পর কমলা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ হয়ে যান। এরপর বলেন, না পশ্চিমের তালা আমি লাগাইয়া দিসিলাম। কোনটা সঠিক- লাগিয়েছিলেন নাকি খোলা দেখেছেন- প্রশ্ন করলে কমলা একটু ক্ষীণস্বরে বলেন, খোলা দেখে এসেছিলাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন হিন্দু তরুণ এ প্রতিবেদককে জানান, তিনিও সে রাতে কীর্তনে ছিলেন। সোয়া আটটার দিকে তিনিসহ সবাই বেরিয়ে যান। তালা দেয়া হয়েছিল কি-না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, গেট চাপানোর পর তালা দিতে আমি দেখিনি। কীর্তন শেষ হবার পর আরও আধ ঘণ্টা আমি জামাই বাজারেই ছিলাম।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল, উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা, ডুমুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবীর তালুকদারসহ প্রশাসন ও স্থানীয় বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিরা আসেন মন্দিরে। তাদের উপস্থিতিতে ও সম্মতিতে ভাঙচুর করা সব দেবদেবী বিসর্জন দেয়া হয়। একইসঙ্গে মন্দির সম্পূর্ণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসু এ প্রতিবেদককে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান আমাদের বলে গেছেন, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এসময় ভাঙচুর ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আসামি তোরাব তালুকদারের বাবা আফজাল তালুকদার ও ভাই মেরাজ তালুকদারসহ স্থানীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে কিছু মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন।
মেরাজ তালুকদার এ প্রতিবেদকের কাছে নিজ ভাইকে একদম নির্দোষ দাবি করে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি জানান, তারাসহ অন্য মুসলিম লোকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যানকে জানিয়েছে, নির্দোষদের যেন হয়রানি না করা হয়। উত্তরে নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, দ্রুতই এ বিষয় মীমাংসা করা হবে।
নিরাপদ বসু এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে বলেন, নির্দোষ কেউ হয়রানি হোক, তা চাই না। আমরা চাই মূল অপরাধীর বিচার। আমরাও একটি সমাধান চাই, যাতে কাউকে হয়রানি না করা হয়। এটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। তারা বলেছেন, বিষয়টি তারা দেখবেন।
অন্যদিকে, যে স্থান ঘিরে মসজিদ নির্মাণ, জায়গা দখলের অভিযোগ করছে হিন্দুরা, সে জায়গায় সোমবার স্থানীয় হিন্দু ব্যক্তিরা দোকানপাট বসিয়ে ফেলেছিল। এ জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেসব দোকানপাট সরিয়ে ফেলা হয়।
সোমবার যে হিন্দু ব্যক্তিরা দোকানপাট বসান, ছয় মাস পূর্বে তাদের দোকান ছিল এখানে। কিন্তু অতি পার্শ্ববর্তী স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শুরু করে ঠিকাদার আমিনুলের মাধ্যমে। তখন কাজের সুবিধার্তে আমিনুল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে দোকানীদের তুলে দেন এই বলে- ‘’কাজ শেষ হলে তারা যার যার জায়গায় বসবেন’’। এ জায়গার একটি স্থানে গোলপাতা দিয়ে ছোট্ট করে গোল আকৃতির একটি বিশ্রামখানা নির্মাণ করেন। যেখানে নির্মাণ শ্রমিকরা মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিতেন, কেউ কেউ নামাজও পড়তেন।
হিন্দুরা অভিযোগ করেন- এ জায়গা দখল করতে উত্তর বাঁশবাড়িয়ার সিরাজ শেখ ও ইজাজ শেখ পাঁয়তারা চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে মাঝে মধ্যে নামাজ আদায়ের অজুহাত দেখিয়ে মসজিদ নির্মাণের চেষ্টা করে। এটা নিয়েই হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধের সূচনা হয় এবং মন্দির ভাঙচুর ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে এখনও পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছেই।