টুঙ্গিপাড়ায় জায়নামাজ ফেলে দেওয়া ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা, প্রভাবশালী হিন্দু-মুসলমানে পূর্বশত্রুতার জেরে
রিকু আমির, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে ফিরে: স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী হিন্দু-মুসলমান মধ্যকার প্রভাব প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কেন্দ্রীক পূর্বশত্রুতা, ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্বের জেরেই টুঙ্গিপাড়ার জামাইবাজার এলাকায় গোলপাতা দিয়ে তৈরি একটি ক্ষুদ্রাকৃতির বিশ্রাম কেন্দ্র থেকে জায়নামাজ ফেলে দেওয়া এবং তিনটি সার্বজনীন মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
গত ২ জানুয়ারি গভীর রাতে গোলপাতার ঘর থেকে জায়নামাজ ফেলে দেওয়া এবং ৪ জানুয়ারি গভীর রাতে তিনটি মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, হিন্দুরা মন্দির ভাঙচুরের জন্য দায়ী করছেন- বড় ডুমুরিয়া ইউনিয়নের উত্তর বাঁশবাড়িয়ার সিরাজ শেখ ও ইজাজ শেখকে। তারা এ-ও বলছেন, ভোগ সূত্রে জামাই বাজার এলাকা যে জায়গা হিন্দুরা দখল করে ব্যবসা করছিলেন, সে জায়গা দখলে নিতে সিরাজ-ইজাজ মরিয়া ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় হিন্দুদের ও প্রশাসনের বাধায় তা না পারায় ‘মসজিদ নির্মাণ’ উপলক্ষ্য তৈরি করে। আর জায়নামাজ ফেলে দেওয়া ও মন্দির ভাঙচুরের জন্য মুসলমানরা একচেটিয়াভাবে দায়ী করছেন- বড় ডুমুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ভাঙচুর ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী সুখময় বাইনকে। স্থানীয়ভাবে চইন্টে নামে তিনি ব্যাপক পরিচিত। বেশকিছু হিন্দুও সুখময়কে দুষছেন গোপনে। এসব হিন্দু সিরাজ-ইজাজ পক্ষের।
দুটো ঘটনা-ই গভীর রাতে ঘটায় এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন-কীভাবে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী হিন্দু-মুসলমান মধ্যকার প্রভাব প্রতিপত্তি, ক্ষমতা কেন্দ্রীক পূর্বশত্রুতা, ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্বের জেরে এসব ঘটনা? এসবের সঙ্গে জায়নামাজ ফেলা ও মন্দির ভাঙচুরের সম্পর্কইবা কী? গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্যও, দেখা গেছে, কীভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি যোগসূত্র আছে।
ডুমুরিয়া, বাঁশবাড়িয়া গ্রামবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, গতবারের আগের বার বড় ডুমুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন সুখময় বাইন। সেবারই চেয়াম্যানপ্রার্থী ছিলেন- উত্তর বাঁশবাড়িয়ার হাসমত আলী শেখ কিনু ও একই গ্রামের মুন্সিবাড়ির রফিক। গ্রামের প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত সিরাজ শেখ কিনুর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। কিন্তু আয়কর বিষয়ে অভিযোগ উঠায় ও তা প্রমাণিত হওয়ায় নির্বাচন থেকে ছিঁটকে পড়েন কিনু। এরপর রফিকের পক্ষে যোগ দেন সিরাজ। সেসময় থেকেই সিরাজের সঙ্গে সুখময়ের বৈরিতার সূচনা ঘটে। সুখময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে একবার তার বিরুদ্ধে ভিজিএফ-এর চাল চুরির অভিযোগ তোলেন ইউপি সদস্যরা। ইউপি সদস্যদের সঙ্গে নাকি সিরাজের হাত ছিল সুখময়কে সরিয়ে দিতে। অবশ্য, পরে প্রমাণিত হয় সুখময় চাল চুরির সঙ্গে যুক্ত নন। তবে এই ঘটনার পর সিরাজের সঙ্গে সুখময়ের বৈরিতা প্রকট আকার ধারণ করে।
গ্রামবাসী জানায়, বহু পুরাতন মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে সিরাজ শেখ এলাকায় পরিচিত। জামাইবাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত তাড়াইল বাজারে তার বড় আড়ৎ, ঘের আছে। তিন-চার বছর আগে সিরাজ ব্যবসায় শুরু করেন জামাই বাজারে। মাছের পাইকারি ব্যবসায় করার পাশাপাশি জামাই বাজার এলাকায় কয়েকটি ঘেরেরও মালিক তিনি। অন্যদিকে, শতভাগ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম বড় ডুমুরিয়া ও ছোট ডুমুরিয়া এলাকায় বহু আগ থেকে মাছ ব্যবসায় ও ঘেরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সুখময়। তার বাড়িও ডুমুরিয়াতেই। সে কারণে ঘেরের মালিকানা নিয়ে সিরাজের সঙ্গে সুখময়ের প্রায়শই গোলযোগ সৃষ্টি হতো। এসব ঘটনা সেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অনেক পরের। এভাবে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে সিরাজ ও সুখময়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটে।
সূত্রগুলো জানায়, সিরাজের ইচ্ছে ছিল- জামাই বাজারে স্থায়ীভাবে দোকান নেবেন। এই দোকান করতে চেয়েছিলেন- পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত নতুন স্লুইস গেট সংলগ্ন খোলা সরকারি স্থানে। এখানেই ছিল সেই গোলপাতার বিশ্রাম ঘর।
গ্রামবাসীরা জানান, সিরাজ ও ইজাজ যে জায়গায় ঘর তুলতে চেয়েছিলেন, সেই জায়গায় ছয়মাস আগে ১০ হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকানপাট ছিল। কিন্তু স্লুইস গেট নির্মাণ কাজের সুবিধার্থে ঠিকাদার আমিনুল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক নেতাদের মাধ্যমে ১০ হিন্দু ব্যবসায়ীকে তুলে দেন অস্থায়ীভাবে। মৌখিকভাবে শর্ত ছিল- কাজ শেষ হলে তারা যার যার জায়গায় দোকান বসাবেন। কিন্তু মাঝখান দিয়ে সিরাজ ও ইজাজ আসায় বিষয়টি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সুযোগটি কাজে লাগান সুখময় বাইন। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে তিনি সিরাজ ও ইজাজের বিরুদ্ধে স্থানীয় হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তুলেন বলে অভিযোগ আছে । এই ঘটনা শুরু হয় গত একমাস আগ থেকে।
গ্রামবাসীরা জানান, ঠিকাদার আমিনুল সেখানে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির গোলপাতার ঘর তুলেছিলেন নির্মাণ শ্রমিকদের বিশ্রামের স্বার্থে। এখানে কিছু নির্মাণ শ্রমিক নামাজ আদায় করতেন। একইসঙ্গে বাজারে বা এই পথ দিয়ে হাতে গোনা কিছু নামাজি মুসলমান যারা আসতেন, তারাও এখানে নামাজ আদায় করতেন। স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর যখন জায়গা দখল নিয়ে সিরাজ-ইজাজের সঙ্গে সুখময়সহ হিন্দু ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তখন গোলপাতার ক্ষুদ্র ঘরটি তুলে ফেলার দাবি উঠে হিন্দুদের পক্ষ থেকে। কিন্তু সিরাজ ইজাজ এতে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, এই বাজারে নামাজ পড়ার কোনো জায়গা নেই। মাঝেমধ্যে কিছু মুসলমান ব্যক্তি আসেন, যারা নামাজ আদায় করতে চাইলে বিড়ম্বনায় পড়েন। অন্ততঃ তাদের জন্য হলেও এই ঘর রাখা প্রয়োজন। দরকার হলে এখানে ছোট করে একটি মসজিদ নির্মাণ করা যেতে পারে, যেন বাজারে আগত মুসলমানরা নামাজ আদায় করতে পারেন। ১৫ বা ২০ জন যাতে দাঁড়াতে পারেন, এমন জায়গা হলেই চলবে। কিন্তু এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে সুখময়ের নেতৃত্বে বড় ডুমুরিয়ার হিন্দুরা ফুঁসে উঠে। অন্যদিকে মসজিদ নির্মাণের জন্য সিরাজ ও ইজাজ স্থানীয় মুসলমানদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা তুলতে শুরু করে দেন।
জায়নামাজ ফেলে দেওয়ার পরদিন জামাই বাজার এলাকায় কিছুটা উত্তেজনা ছড়ায়। কিছু মুসলমান হিন্দুদের কটাক্ষ করে কথা বলে জায়নামাজ ফেলে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান এবং মসজিদ নির্মাণের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এসব মুসলমানদের বেশিরভাগই সেই মুসলমান, যাদের কাছ থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য আর্থিক সহযোগিতা তোলা হয়েছিল বা হচ্ছিল বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সম্পাদনা: এনামুল হক