টুঙ্গিপাড়ায় জায়নামাজ ফেলা ও মন্দির ভাঙচুর হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক বিভেদ চলছে
রিকু আমির, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে ফিরে: টুঙ্গিপাড়ার জামাই বাজার এলাকায় একটি ক্ষুদ্রাকৃতির গোলপাতা দিয়ে নির্মিত ঘর থেকে জায়নামাজ ফেলে দেয়া, এক ছাদের নিচে থাকা তিনটি সার্বজনীন মন্দির ভাঙচুর এবং ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রভাবে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক অশান্তি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
গত ২ জানুয়ারি জায়নামাজ ও ৪ জানুয়ারি মন্দিরগুলোয় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর ঘটনায় স্থানীয় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় হিন্দু সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি সুখময় বাইন বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৩০-৩৫জনকে আসামি করে টুঙ্গিপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয় ৩জনকে।
সরেজমিনে জানা যায়, ঘটনাস্থল বড় ডুমুরিয়া গ্রামে অবস্থিত। এর আশপাশে রয়েছে- ছোট ডুমুরিয়া, বাঁশবাড়িয়া, পাকুন্দি, ঝনঝনিয়া, লেবুতলা গ্রাম। ছোট-বড় ডুমুরিয়া, বাঁশবাড়িয়া ও পাকুন্দিতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ছোট-বড় ডুমুরিয়ায় হিন্দুদের সংখ্যা শতকরা ৯৫ ভাগ। বাঁশবাড়িয়ায় হিন্দুদের সংখ্যা শতকরা ৮৫ ভাগ বলে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়। ঘটনার প্রভাব বিস্তার করেছে- ছোট-বড় ডুমুরিয়া, বাঁশবাড়িয়া, পাকুন্দিতে। মামলার আসামিদের (সোহেল বাদে) প্রত্যেকের বাড়ি এই তিনগ্রামে। ফলে গ্রেফতার আতংকে আসামিরা ছাড়াও অন্য পুরুষরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। দিনে লুকিয়ে লুকিয়ে এটা ওটা করলেও রাত কাটাচ্ছেন- ফসলি জমি, পুকুর পাড় বা দূরবর্তী শহর-গ্রামে অবস্থিত স্বজনদের বাড়িতে।
মামলায় যে ২০জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে, সেই ২০ জনের মধ্যে সবার পরিবার নিজ নিজ ব্যক্তিকে নির্দোষ দাবি করছেন। এসব পরিবারের মধ্যে বেশিরভাগই দরিদ্র ও হতদরিদ্র শ্রেণির। সকালে কাজে না গেলে বিকালে বাজার হয় না-এমন। পরিবারগুলোর জোরালো অভিযোগ-মামলা দিয়ে হিন্দুরা পুলিশ দিয়ে তাদের হয়রানি করছে। সরেজমিনে আসামিদের বাড়ি ছাড়াও অন্য মুসলিম ও হিন্দু বাড়িতে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। জায়নামাজ ফেলা ও মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলে মুসলমানরা হিন্দুদের উপর ক্ষুব্ধ ও আতংকগ্রস্ত। অন্যদিকে মন্দির ভাঙচুর করায় হিন্দুরা ক্ষুব্ধ মুসলমানদের উপর।
ছোট ডুমুরিয়ার বাসিন্দারা আবেজানের হয়ে তার নিকটাত্মীয় হোসনে আরা এ প্রতিবেদককে জানান, আবেজানকে তার খুব নিকট প্রতিবেশি হিন্দু বাড়ির নারীরা নাকি বলেছে, বাঁচতে চাইলে তারা যেন শাঁখা সিঁদুর পরিধান করে। না হলে মামলা দিয়ে শায়েস্তা করে দেবে।
আবেজান সেসময় বাড়ি ছিলেন না বলে তার কাছ থেকে এ কথার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং সেই প্রতিবেশি হিন্দু বাড়ি সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি।
অন্যদিকে, উত্তর বাঁশবাড়িয়ার বাসিন্দা মাহমুদা জানান, তাকে রমণীর স্ত্রী গৌরি বলেছেন, যারা মসজিদের জন্য চাঁদা দিয়েছে তাদেরকে পুলিশ ধরবে। একেবারে শাঁখা সিদুর পরিয়ে নাকি ছেড়ে দেবেন।
কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যাওয়া হয় গৌরির কাছে। এসব কথা বলেছেন কি-না- জানতে চাইলে গৌরি চেঁচিয়ে ভগবান নাম জপে বলেন, বলি নাই, বলি নাই……।
এ ধরনের আরও কিছু ঘটনা এসেছে এ প্রতিবেদকের কাছে। হাটবাজারে হিন্দু-মুসলমানে আর্থিক সম্পর্কেও এসেছে তিক্ততা, ক্ষুব্ধতা বলে জানা গেছে।
ছোট ডুমুরিয়া গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী হেকমত জানান, তিনি জামাই বাজারে দুধ বিক্রি করতেন। বড় ডুমুরিয়ার একজন হিন্দু মিষ্টি ব্যবসায়ীর কাছে তিনি ৫ হাজার টাকা পান। ঘটনার আগে কখনও টাকা নিয়ে নয়ছয় না করলেও এখন সেই মিষ্টি ব্যবসায়ী নাকি তাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। ওদিকে ভয়ে সেই ব্যবসায়ীর বাড়িতেও যেতে পারছেন না হেকমত।
গোপালগঞ্জের একটি কলেজের হিন্দু শিক্ষক নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে জানান- এখন না হয় পরিস্থিতি থমথমে। এজন্য ক্ষোভ চাপা পড়ে আছে। চলমান ঘটনার জেরে একটা সময় হিন্দু-মুসলমানে গভীর তিক্ততা, বৈরিতা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। তখন পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই হবে চ্যালেঞ্জ।
ভাঙচুরের শিকার মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ বসু এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা কোনোভাবেই সামাজিক অশান্তির পক্ষে নই। এখানকার সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য কাজ করা হবে। সম্পাদনা: এনামুল হক