খবরকে খাবার করবার নিয়মাবলী
যায়নুদ্দিন সানী
খবরের বাজার এখন কেমন মনে হচ্ছে? গরম? অ্যাজ ইউজুয়াল? না ‘দূর কোনো খবরই নেই?’ টাইপ? আমার মতে এখন অবস্থাটা ‘অ্যাজ ইউজুয়াল’ আর ‘দূর কোনো খবর নাই’ এর মাঝামাঝি। না আছে বিরোধী দলের আন্দোলন, না আছে বড়সড় কোনো স্ক্যান্ডাল। খবর বলতে তো একটা দুটা ছোটখাট স্ক্যান্ডাল, বিএনপি বা লীগের কোনো নেতার উদ্ভট কোনো মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর কোনো ঘোষণাÑব্যাস। পত্রিকা পড়া শেষ। মফস্বলের খবর কি কেউ পড়েন? খেলাধুলার পাতা হয়তো পড়েন, তা-ও আবার ক্রিকেট খেলা চলাকালীন। ইদানিং অবশ্য ক্রেজ চলছে মহিলা ফুটবল কিংবা মহিলা ক্রিকেটের খবর রাখবার। বিদেশের খবর? সেখানেও তো একই খবর খোঁজেন। এই কিছুদিন আগেও তো ছিল ট্রাম্প কাহিনী পাঠ। আর কিছু কি পড়তেন? কিংবা এখন? মজাদার খবরের অভাবে সেখানেও এখন কিছুটা মন্দাভাব চলছে। অ্যান্ড দ্যাটস ইট। পত্রিকা শেষ।
সো? কীভাবে চলবে আপনার সকালের চা খাওয়া? রাগে পত্রিকার সাবস্ক্রিপশান কি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখবেন? সমস্যা যে কেবল আপনার তা কিন্তু না। সমস্যা আমাদেরও, মানে কলামিস্টদেরও। আমাদের কাজ আসলে কি? এই হাবিজাবি খবরগুলোর ভেতর থেকেই কোনো একটা খবরকে ‘উপাদেয় খাবার’ বানানো। মাল মসলা মিশিয়ে এমনভাবে খাওয়ানো, যেন আপনারা ভাবেন, ‘আরে তাই তো, খেতে তো বেশ মজা!’ আপনাদের জন্য মজা করে রান্না করতে গিয়ে কখনও কখনও ‘খবর’ তার সততা হারায়। কখনও মেশে ভেজাল। সততা হারানো কিংবা ভেজাল মেশানো অবশ্য দলবাজির জন্যও করি, সেটা অন্য হিসাব। সেটার বিনিময়ে কিছু প্রাপ্তি থাকে। কিন্তু কেবল খবর বানাবার জন্য যে হেরফের করি, সেটায় আমাদের আসলে কেবল চেষ্টা থাকে একটাই, আপনি যেন খাবারের টেবিল থেকে উঠে না যান। যেন না বলেন, ‘কী সব রান্না করেছ?’
এই মানসিকতাটা সবক্ষেত্রেই। প্রিন্টেড বলুন আর অনলাইন, ফেসবুক বলুন আর ব্লগ। কমবেশি সবাই একই রেসের ঘোড়া। সবারই একই চাওয়া, ‘আমারটা খাও, এটা বেশি মজা।’ সমস্যা শুরু হয়, যখন খাবারটা আধা মজা হয়, তখন। ‘লিটন সাহেব মদ্যপ অবস্থায় গুলি করেছেন’Ñ খবরটা কেমন পানসে হয়ে যায় না? ‘টার্গেট প্র্যাকটিস’ ‘অবোধ শিশুটির কী দোষ ছিল’ এমন সব কথা খবরটার সঙ্গে যোগ করলে? একটু মজাদার হয় না? ‘একজন চেতনাবাদীর টার্গেট প্র্যাকটিস’ যোগ করলে? আওয়ামী বিরোধীরা একেবারে লুফে নেবে, তাই না? খাবার মজাদার করবার এই রেসে তাই কমবেশি সবাই নেমে পড়ে। পক্ষেও যেমন নামে, বিপক্ষেও।
লিটন সাহেবের মৃত্যুও ব্যতিক্রম হয়নি। পুরনো স্মৃতি টানতে কেউই কার্পণ্য করেননি। কেউ টেনেছেন, গোলাম আজমের জনসভা করতে না দেওয়ার স্মৃতি, কেউবা আবার দরদ উথলেছেন সেই শিশুর জন্য। কেউ টানছেন, দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কেউবা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। তাঁর পিস্তল কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা, পুলিশের অকর্মন্যতা থেকে শুরু করে খুনের মোটিভ নিয়ে সবাই যোগান দিয়েছেন নানান তত্ত্ব। আত্মীয়-স্বজনের আহাজারি কিংবা সাঁওতাল ইস্যুর সঙ্গে ব্যাপারটাকে মেলানো, খবর হিসেবে কোনোটাই পরিবেশন করতে বাদ রাখা হয়নি। কম হোক আর বেশি হোক, প্রায় সবগুলোই উপাদেয় ছিল। জনগণ বেশ পেট পুরেই খেয়েছে।
আচ্ছা বলুন তো, ‘অসাবধানে রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়ে যায়।’ এমন খবর কি কেউ খেতেন? না, খেতেন না। বলতেন, পয়সা খেয়ে, খবরটা নরম করে লিখেছে। কিংবা সততায় আঘাত না করে সাহসে আঘাত করতেন, বলতেন ‘কাপুরুষ’। লিটনের খুন হওয়ার পরও, ‘আততায়ীর গুলিতে খুন’ এমন খবরের চেয়েও অনেক বেশি চেয়েছেন, ‘লিটনের খুনের পেছনে জামায়াত শিবির?’ এমন কোনো খবর। আমরাই ঠিক তাই করেছি। যেমনটা চেয়েছেন, সেভাবেই পরিবেশন করেছি। কেউ কেউ মেনু চেঞ্জ করেছি, সেটা কাস্টমারের টেস্টের কথা ভেবে। আমাদের কাজ হচ্ছে, শুধু আঁচ করা, কোন খাবার কি রেসিপিতে আপনি খেতে চান, তা খুঁজে বের করা। আওয়ামী মেনু? না বিএনপি মেনু? সততা এখানে জরুরি নয়।
এই দেখুন না, লিটন ইস্যু যে এখন আর খাবেন না, আমরা কিন্তু বুঝে গেছি। এখন সবচেয়ে উপাদেয় হচ্ছে, নাহিদ সাহেব আর পাঠ্যপুস্তকে ভুল। গাছের নিচে একটা ছাগল দাঁড়িয়ে আছে। গাছে ঝুলছে আম। শুরু হয়ে গেল ক্রিয়েটিভিটির খেলা। ছাগলকে গাছে ছড়ানো থেকে শুরু করে নাহিদ সাহেবের গোষ্ঠী উদ্ধার। মসলা যোগান আসতেই থাকল। ‘আসলে সরকারের কি উদ্দেশ্য?’এনিয়ে আসতে থাকল বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত। প্রায় সবই কাছাকাছি, শুধু বলায় বিভিন্নতা। কমবেশি সবাই একমত, পেছনে আছেন হেফাজত। প্রমাণ জরুরি না, খাবারটা উপাদেয় হওয়া জরুরি। ফলাফল? আর্টিস্ট বেচারার চাকরি গেল।
খবরের আরেকটা শাখা আছে। বেশকিছু লেখা এবার বাদ পড়েছে, আর কিছু নতুন লেখা যুক্ত হয়েছে। বাজারে জোড় গুজব, এসব ঘটনা হেফাজতের নির্দেশে হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী অস্বীকার করেছেন, তবে তা পাবলিক খাচ্ছে না। আর তাই আমরাও তা খাওয়াবার চেষ্টা করছি না। প্রমাণ থাকুক আর না থাকুক, নতুন নতুন তত্ত্ব হাজির করা হচ্ছে। মন্ত্রী সাহেব ছাত্র বয়সে বাম ছিলেন, তাই বাচ্চা আওয়ামীরা তাঁকে নিজের মনে করছে না আবার দল পালটাবার কারণে বাচ্চা বামেরাও তাঁকে পছন্দ করছে না। ফলাফল? তাঁর জন্য বরাদ্দ হচ্ছে মজার সব উপাধি।
এনিওয়ে, এসব মসলাদার খাবার পরিবেশন করে, আমাদের সময় খুব একটা খারাপ কাটছে না। সমস্যা হচ্ছে, যতই মজাদার হোক, একই খাবার আমরা বেশিদিন খেতে পছন্দ করি না। লিটন ইস্যু তো দেখতে দেখতে তার স্বাদ হারাল। পাঠ্যপুস্তক ইস্যুতে স্বাদ এখনও আছে। নিত্য নতুন ক্রিয়েটিভিটি আসছে। শিক্ষামন্ত্রীর ‘আঠা তত্ত্ব’ পাবলিকের বেশ পছন্দ হয়েছে। কমবেশি সবাই এখন এনিয়ে মেতে উঠেছে। আমরাও লিখছি, খাওয়াচ্ছি।
ওদিকে ইমরানের বিয়ে মজার একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গণজাগরণ এখন কী করবে? এটা অবশ্য ঠিক প্রশ্ন না, এটা এখন বেশ চটকদার একটা খবর। জামাই ইমরান বনাম আক্টিভিস্ট ইমরান। সবাই অপেক্ষা করে আছে, এই খেলা দেখবার জন্য। খেলা অবশ্য শুরু হয়ে গেছে, ইমরানের নিশ্চুপ থাকা মানেই, ইমরান জামাই হিসেবে খেলছে। তবে পাবলিক চাইছে, আক্টিভিস্ট ইমরানও খেলুক। বা বলা যায়, সেটা অনেক মজাদার খাবার হবে। সেটা আদৌ হবে কি না, এই মুহূর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে ইমরানের সাম্প্রতিক লেজ, ছাত্র ইউনিয়ন তাঁদের অবস্থান ঠিক করে ফেলেছে। তাঁদের পুরনো কমরেড নাহিদ সাহেবকে লাথি মারতে কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছে। খবর হিসেবে খুব মজাদার না হলেও, নেহাৎ বিস্বাদ না।
ইদানিং আরও কিছু খবর উল্টোভাবে এসেছে। ৫ জানুয়ারি বিএনপি কিছু করতে পারবে না, জানাই ছিল। তবে আওয়ামীরা যে রাস্তা জ্যাম লাগিয়ে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ ঘটাবে এটা কারো মাথায় আসেনি। ফলে, ভুলে যাওয়া ৫ জানুয়ারি খবর হল। ওদিকে আবার ১০ জানুয়ারির উদযাপন, ঠিক আলিশান স্টাইলে হয়নি। কেন হয়নি? তা নিয়ে অনেকেই বেশ চিন্তিত। তত্ত্ব হাজির হতে শুরু হয়েছে। তবে পাবলিক খাচ্ছে না। স্ক্যান্ডাল না থাকলে কোনো খবরকেই মজাদার বানানো টাপ। ‘প্রধানমন্ত্রী রাগ করেছেন’ কিংবা ‘ওবায়েদুল কাদের সাহেব বকা খেয়েছেন’ এমন কিছু যোগ না হলে মনে হয় না, খবরটা খুব মজাদার হবে।
কিছু খবর মজাদার বানাতে হয়, আর কিছু খবর মজাদার হয়েই জন্মায়। আর মজাদার খবর জন্ম দিতে সবচেয়ে এগিয়ে সম্ভবত দুই দলের প্রবক্তারা। সম্প্রতি দুদু সাহেবও নেমেছেন এই লাইনে। ‘জিয়া সিটি’ নিঃসন্দেহে হিট। ওদিকে হাসান সাহেব পাল্টা ফর্মূলা এখনও হাজির করেননি। আশা করছি মজাদার কিছু পাওয়া যাবে। ‘জিয়া সিটি’ এই মুহূর্তে হালকা টাইপের খাওয়ার মনে হলেও, কখনও যদি গদি পরিবর্তন হয়, তখন বেশ মজাদার খাবার হবে বলেই মনে হচ্ছে। তখন অবশ্য নাম পরিবর্তনের হিড়িক পড়বে বলেই মনে হয়। আমরাও যে তখন ভাষা পাল্টাবো, টার্গেট পাল্টাবো, সেটা তো জানেনই। আপাতত সেটা ইস্যু না।
তনু, অভিজিৎ কিংবা (আর তো কারো নামই মনে পড়ছে না) রানা প্লাজা, এসব নিয়ে লিখলে কি খাবেন? বলবেন, ‘দূর, কী পুরান কাসুন্দি ঘাঁটছে’। আসলে ওসব খবরে দারুণ নতুনত্ব না এলে, আপনারা যে খাবেন না, তা আমরা জানি। তাই ওসব খাবার আমরাও হাজির করব না। শুধু কি তাই? ডিসিসি মার্কেট কিংবা লিটনের ‘আসল (?)’ খুনি শনাক্ত করাই তো এখন আর কোনো খবর না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কিংবা লিটন সাহেবের স্ত্রীর আহাজারি দেখলে আপনি এখন চ্যানেল পালটাবেন। বাজি ধরবেন?
এনিওয়ে যে কারণে আজকে লিখতে বসেছিলাম, তা হচ্ছে আমাদের সমস্যা বোঝানো। এখন নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন, মজাদার খবরের আকাল পড়লে আমরা কী সমস্যায় পড়ি। খবরের এই আকালে কলাম লেখা কতটা কষ্টকর। কখনও তাই খবরকে টুইস্ট করতে হয় আর কখনওবা বানাতে হয়। উদ্দেশ্য তো একটাই, আপনাদের যেন খেতে খারাপ না লাগে। ক্লিয়ার?