মুসা ও মেজর জাহিদের উত্তরার লাইফ স্কুলে যাতায়াত ছিল নিয়মিত র্যাবের হাতে গ্রেফতার শরিফুল জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতা?
বিপ্লব বিশ্বাস: নব্য জেএমবির জঙ্গি নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা ও মেজর জাহিদের লাইফ স্কুলে যাতায়াত ছিল। ২০১৫ সাল থেকেই তারা ওই স্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে, গ্রেফতারকৃত শিক্ষক শরিফুলকে নিয়ে সন্দেহ বেড়েই চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, শরিফুল হয়তো কোনো এক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতা হতে পারে। এ বিষয়ে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, ‘মুসা ও অন্য জঙ্গিদের সঙ্গে এদের (শিক্ষক) সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমরা তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করছি।’ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও র্যাব ৪-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার উনু মং বলেন, ‘লাইফ স্কুলে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। শরিফুলের নেতৃত্বে ছিল একটি গ্রুপ। গ্রুপিংয়ের জের ধরে শরিফুল স্কুল থেকে বের হয়ে নতুন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। শরিফুল সবকিছুই জানে, তবে সে এখনই মুখ খুলছে না।’ উনু মং বলেন, ‘আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তবে তারা অনেক কৌশলী। তাদের কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি ঘটনা একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত।’
গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এক নারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব ৪-এর সদস্যরা। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, আবু সাদাত মো. সুলতান আল রাজি ওরফে লিটন (৪১), আল মিজানুর রশিদ (৪১), জান্নাতুল মহাল ওরফে জিন্নাহ (৬০), মো. জিয়াউর রহমান (৩১), মো. কৌশিক আদনান সুবহান (৩৭), মিজানুর রহমান (৪৩), মেরাজ আলী (৩০), মুফতি আবদুর রহমান বিন আতাউল্লাহ (৩৭), শাহরিয়ার ওয়াজেদ খান (৩৬) ও শরিফুল ইসলাম শরীফ (৪৬)। এদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম শরীফ লাইফ স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ ও শাহরিয়ার বর্তমান অধ্যক্ষ। মিজানুর রহমান শরিফুলের ভাগ্নে। সেও এই স্কুলের সঙ্গে জড়িত ছিল।
র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেফতারের পর আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করে র্যাব। আদালত আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। র্যাবর জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসার সঙ্গে এই স্কুলের একাধিক শিক্ষকের সম্পর্কের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। র্যাব জানায়, স্কুলটি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও পুরোদমে এটি চালু হয় ২০১৩ সালের দিকে। মিরপুরে নিহত জঙ্গি মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদের মৃত্যুর পর লাইফ স্কুলের সন্ধান পায় পুলিশ ও র্যাব। এরপর স্কুলটির কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। সেখানে কর্মরত শিক্ষক, স্টাফ ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও তথ্য সংগ্রহ করে তারা। স্কুলটিতে ২০১৫ সালে ফয়সাল হক নামের এক শিক্ষক যোগ দেয়। একই বছর মাইনুল ইসলাম মুসাও যোগ দেয় ওই স্কুলে। তারা দুজন গত বছরের মার্চে স্কুল ছেড়ে চলে যায়। এর মধ্যে গত ২৪ ডিসেম্বর দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনার একটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে। তাদের একজন জঙ্গি মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসার স্ত্রী তৃষামনি। মুসা লাইফ স্কুলে শিক্ষকতা করেছে। এসময় মেজর জাহিদেরও ওই স্কুলে যাতায়াত ছিল। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময় তারা উত্তরাতেই ছিল। মার্চে তারা উত্তরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এরপর মেজর জাহিদ, মুসা ও ফয়সাল লাইফ স্কুলে সাক্ষাৎ করত। এসব জঙ্গিদের ওই স্কুলে যাতায়াতের কারণ ক্ষতিয়ে দেখছে র্যাব।
জানা গেছে, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে লাইফ স্কুল অবস্থিত। ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে বাড়িওয়ালা মৃত ড. মো. গোলাম আলী ফকিরের পরিবার। বাকি ভবনের পুরোটাই ব্যবহার করে লাইফ স্কুল। ২০১২ সালের দিকে আট ব্যক্তির উদ্যোগে শুরু হয় লাইফ স্কুলে যাত্রা। উদ্যোক্তাদের চার জন একটি বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির প্রকৌশলী। বাকিদের একজন বুয়েটের শিক্ষক, একজন কানাডা প্রবাসী, একজন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও অন্যজন রাজধানীর একটি কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে এই স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
এদিকে, লাইফ স্কুলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নোটিশ টানিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুলটি। তবে স্কুলের কর্মচারীদের যাতায়াত এখনও রয়েছে। স্কুলটির রিসিপশনিস্ট ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমি এখানে যোগ দিয়েছি চার মাস আগে। কী হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে স্কুল বন্ধ থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই মাস আগে পুলিশ ও র্যাব কয়েকবার আমাদের এই স্কুলে এসে তল্লাশি চালিয়েছে। কিছুই পায়নি তারা। তবে সবার তথ্য নিয়ে গেছে।’ গেটের ভেতরে অন্য এক কিশোর নিজেকে স্কুলের বাবুর্চি পরিচয় দিয়ে বলে, ‘আমি এখানে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করছি। কেন স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তা আমরা জানি না।’ সম্পাদনা: এনামুল হক