বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপ্তি আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত তুরাগ পাড়
নাঈমুল হাসান, টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি: আখেরি মুনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব । বেলা ১১টায় শুরু হওয়া প্রায় ৩৫ মিনিটের এ মুনাজাতে অংশ নেয় লাখো মুসল্লি। ১৩ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসলমানদের বৃহত্তম জমায়েত প্রথম পর্বের আখেরি মুনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লির মারকাজের সূরা সদস্য হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। আরবি ও উর্দু ভাষায় মুনাজাত করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে হাত তুলেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুণাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বিপদ-মুসিবত থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে তুরাগ তীর মুখরিত হয়ে উঠে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মুসল্লিরা। দেশ বিদেশের প্রায় ৬ লাখ মুসল্লি মুনাজাতে অংশগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে ফজরের নামাজের পরই উর্দুতে হেদায়েতি বয়ান শুরু করেন মাওলানা সা’দ। বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের। হেদায়েতি বয়ান শেষে বেলা ১১টায় আখেরি মুনাজাত শুরু হয়।
মুসল্লির মৃত্যুঃ ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহত মুসল্লির নাম বেদন মিয়া (৫০), তিনি ঢাকা জেলার বাসিন্দা। এর আগে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়ে আরও ৭ মুসল্লির মৃত্যু হয়। রোববার সকাল পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমায় এ মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেন ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরব্বি মো.গিয়াস উদ্দিন।
এর আগে ৭ জন হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জগৎ সাহ গ্রামের তারা মিয়া (৫৫),ফেনীর দাগন ভূইয়া উপজেলার মাছিমপুর এলাকার বাবুল মিয়া (৬৫), মানিকগঞ্জের সাহেবআলী (৪০), কক্সবাজারের হোসেন আলী (৬০), সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খেজুর ডাঙ্গা এলাকার আব্দুস সাত্তার(৬৫), টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার জান ফকির (৬৮) এবং ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ফজলুল হক (৬০)।
যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ: আখেরি মুনাজাত উপলক্ষে রোববার ভোররাত ৩টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এয়ারপোর্ট থেকে জয়দবেপুর চৌরাস্তা, ঢাকা-সিলেট সড়কের গাজীপুর সদরের মীরের বাজার থেকে টঙ্গী ও আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাস সড়ক পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ইজতেমায় আগত আশপাশের মুসল্লিদের পায়ে হেঁটে মুনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস: আখেরি মুনাজাত উপলক্ষে বিশেষ বাস ও ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। এ উপলক্ষে ১১৪টি ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রাবিরতিসহ মুনাজাতে অংশ নেয়ার জন্য টঙ্গী ও আশপাশের এলাকার জন্য ২১টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয় বলে নিশ্চিত করেন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো.হালিমুজ্জামান। এছাড়া ২২৮টি বিআরটিসি বাস ও র্যাবের সাটল গাড়ি মুনাজাতে আগত মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য ব্যবস্থা করা হয়।
বাড়ি ফেরায় চরম দুর্ভোগ ঃ মুনাজাত শেষে মুসল্লিগণ তাদের ফিরতি যাত্রায় চরম ভোগান্তির শিকার হন। যানবাহন পর্যাপ্ত না থাকায় অনেককে পায়ে হেঁটে,ভ্যানে চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দেখা যায়। দীর্ঘ সময় যানচলাচল বন্ধ থাকায়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কিছু বেগ পেতে হয় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে।
বিদেশিদের আগমনঃ বিদেশি মুসল্লিরা মাঠের উত্তর পশ্চিম পাশে অবস্থান করছেন, ইতোমধ্যে ৯১টি দেশের প্রায় ৭৮০৪ হাজার বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। ইজতেমার মূল বয়ান মঞ্চ থেকে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও সঙ্গে সঙ্গে ওই বয়ান বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিদের জন্য অনুবাদ করা হয়।
ভিআইপিদের অংশগ্রহণ: এছাড়াও ইজতেমায় মুনাজাতে অংশ নেন- ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আলহাজ অ্যাড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, স্থানীয় সাংসদ আলহাজ মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুণ-অর-রশিদ,গাসিক (ভারপ্রাপ্ত) মেয়র মো.আসাদুর রহমান কিরণ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
মহিলাদের অংশগ্রহণ ঃ আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লি ও আগের রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিল কারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।
গণমাধ্যমে মুনাজাত: ইজতেমা ময়দানে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে না পারায় অনেকে রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে মুনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মুনাজাতের সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, রেডিও সরাসরি সম্প্রচার করে। পাশাপাশি ছবি সংগ্রহকারীদের ছবি সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
শেষ সময়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা: এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রায় সাত হাজারের অধিক পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি রয়েছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে আকাশে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল, নৌ-পথে স্পীড বোটে সতর্ক টহল ও নজরদারী। আকাশ ও নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসল্লিসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দানকে ঘিরে থাকা সিসিটিভি মাধ্যমে নিরাপত্তা কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে স্থাপিত পুলিশ র্যাবের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছে। তাছাড়া ইজতেমার প্রথম পর্বের মুনাজাত অনুষ্ঠিত হওয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। যে কোনো ধরনের নাশকতা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হারন অর-রশিদ জানান, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে আগামী দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা পর্যন্ত।
যে কারণে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা: তাবলীগ জামাতের মুরব্বিগণ জানান, সারা বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ইজতেমায় শরীক হওয়া মুসল্লিদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের সময় টঙ্গী তুরাগ তীরের এ বিশাল ময়দানেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। আগত মুসল্লিদের যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাই বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের অসুবিধা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ২০১১ সাল থেকে দুই দফায় ইজতেমা সম্পন্নের ব্যবস্থা করেছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটি। যারা প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিবেন তারা দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিবেন না। প্রথম পর্বের আখেরি মুনাজাত শেষে মুসল্লিগণ ময়দান ছেড়ে দেওয়ার পর দ্বিতীয় পর্বে জেলা ওয়ারি নির্দিষ্ট খিত্তায় মুসল্লিগণ ময়দানে এসে অবস্থান নিবেন, বয়ান শুনবেন এবং দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাতে অংশ নিবেন। দ্বিতীয় পর্ব শেষে নিজ নিজ ঠিকানা ও গন্তব্যে ফিরে যাবেন। এর মাধ্যমে শেষ হবে এবারের ৫২তম বিশ্ব ইজতেমা।
ইজতেমা ময়দানে হকার উৎপাত: কড়া নজরদারির মধ্যদিয়ে ও এবার প্রথম পর্বের ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীতে বিপুলসংখ্যক হকার বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি সড়ক-মহাসড়ককে বেচাকেনা করতে দেখা যায়। এতে মুসল্লিদের স্বাভাবিক চলাচলে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব হকার নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যদ্রব্য অতিরিক্ত ক্রেতা পেয়ে ইচ্ছেমত দাম হাঁকছেন বলে অভিযোগ ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের। সম্পাদনা: এনামুল হক