নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন নূর হোসেন-তারেক সাঈদসহ ২৬ জনের মৃত্যুদ-, ৯ জনের কারাদ-
হাসান আরিফ: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের পৃথক দুই মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেন, বরখাস্তকৃত র্যাব কমকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ২৬ আসামির মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। আর বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় মোট আসামি ৩৫ জন।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন সকাল দশটা এগারো মিনিটে এই রায় দেন। আইনজীবী, সংবাদকর্মী আর শৃঙ্খলাবাহিনীর সদ্যস্য এসময় আদালত কক্ষে দাঁড়ানোর মত জায়গাও ছিল না। তবে আদালত চত্বরে কোনো র্যাব সদস্যকে দেখা যায়নি। রায় ঘোষণার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলামের সমর্থক এবং আইনজীবী চন্দন সরকারের সমর্থকরা আদালতের বাইরে উল্লাসে ফেটে পড়েন। রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই র্যাবের সাবেক সদস্য।
মৃত্যুদ- পাওয়া র্যাব-১১ এর সাবেক সদস্যরা হলেন বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর। মৃত্যুদ- পাওয়া বাকিরা হলেন মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন, তাঁর সহযোগী মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান (চার্চিল), সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। মৃত্যুদ- পাওয়া আসামিদের মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ ও শাহজাহান পলাতক রয়েছেন।
বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- পেয়েছেন র্যাব-১১-এর সাবেক সদস্য এএসআই আবুল কালাম আজাদ (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), করপোরাল মোখলেছুর রহমান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), করপোরাল রুহুল আমিন (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), কনস্টেবল বাবুল হাসান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর, সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর) ও সৈনিক নুরুজ্জামান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর)।
মৃত্যুদ-ের রায় শোনার পর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা স্বাভাবিক ছিলেন। তবে মৃত্যুদ- পাওয়া কয়েকজনকে উচ্চ স্বরে কাঁদতে দেখা যায়। এ সময় নূর হোসেন তাদেরকে সান্ত¡না দেন।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, তিনি রায়ে সন্তুষ্ট। তিনি দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানান।
চন্দন সরকারের মেয়ে সুস্মিতা সরকারও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও বলেন, আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর হোক- এটাই তাদের চাওয়া।
চন্দন সরকারের পরিবারের হয়ে এ মামলা লড়েন আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান, যিনি গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই রায়ে আমরা আনন্দিত। আমরা খুশি হয়েছি। ৩৫ জন আসামির মধ্যে সবার মৃত্যুদ- হলে আরও বেশি খুশি হতাম।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ছিল। আদালতসহ আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় জলকামান, পুলিশভ্যান ও প্রিজনভ্যান। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সকালে আসামিদের আদালতে আনা হয়। রায়কে কেন্দ্র করে আদালতে অন্যান্য মামলা পরিচালনা বন্ধ রাখা হয়েছিল।
গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে সকাল পৌনে ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হয় নূর হোসেন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট (বরখাস্তকৃত) কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, বরখাস্তকৃত কমান্ডার এম এম রানা, বরখাস্তকৃত মেজর আরিফ ও বরখাস্তকৃত ল্যান্স নায়েক বেলালকে। প্রায় একই সময়ে মামলার বাকি ১৮ আসামিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
গত ৩০ নভেম্বর দুই মামলার ওপর শুনানি শেষে ১৬ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন কারাবন্দি আছেন। এদের মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দিয়েছিলেন।
পলাতক আসামিরা হলেন কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান হাবিব এবং নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন।
এ মামলায় সাক্ষী করা হয় ১২৭ জনকে। ১০৬ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। এদের মধ্যে ২০ জন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন মেলে আরেকটি লাশ।
নিহত বাকিরা হলেন নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।
এরপর ২৮ এপ্রিল নিখোঁজ নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি প্রথম মামলা করেন। আর ৮ মে নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দ্বিতীয় মামলা করেন।
২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ২০১৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে চার্জ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়। সম্পাদনা: এনামুল হক