সাউথ এশিয়ান মনিটরে ড. মাইমুল আহসান খানের সাক্ষাৎকার ‘বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান টাইগার’
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
সাউথ এশিয়ান মনিটরকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ও কয়েক ডজন গ্রন্থের রচয়িতা ড. মাইমুল আহসান খান বলেছেন, দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে, যা তার স্বকীয় অবস্থানকে উদীয়মান টাইগারে পরিণত করেছে। গত ১৮ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সার্ক প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূত হয়ে এই অঞ্চলের সকল দেশের মাঝে পারস্পরিক সংযোগ, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও সীমান্তের নিরাপত্তা ত্বরান্বিত করেছে। তথাপি দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর আধিপত্যপূর্ণ প্রতিযোগিতার কারণে পুরো অঞ্চলটিতেই উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার সাফল্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ থাকলেও মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নির্যাতিত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য উপর্যুপরি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ‘বাংলাদেশ-মায়ানমার’ সম্পর্ককে ক্রমেই জটিলতর করছে।
তিনি বলেন, বিশ্বায়ন ও ধর্মীয়-জাতিসত্তার প্রেক্ষাপটে বাংলা ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পর্কটি হাজার বছরের পুরনো। সে কারণে কয়েক দশকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও অত্যাচারে পলায়নপর রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত। অথচ আমাদের অদূরদর্শিতার কারণে রোহিঙ্গারা কখনো ‘বোঝা’ ও কখনো ‘সমস্যা’ হিসেবে বিবেচিত। ফলে তাদের নিধনে আমরা নির্বাক তাকিয়ে দেখছি এবং তাদের উদ্ধার ও রক্ষায় আমাদের মানবিকতা জাগ্রত হচ্ছে না। এমনকী প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের এই রোহিঙ্গাদের বিপুল মানবিক সংকট নিরসনে কখনোই সহযোগিতার হাত বাড়াবে না, কেননা তার রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। বরং তা যেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবাহী অধ্যায়কে উদ্ভাসিত করে, সেটাই চায় ভারত, পাকিস্তান ও চীন।
ড. মাইমুল আহসান খান বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে দুই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু হওয়ায় চীনের প্রাচুর্য ভিন্নধর্মী। সে জন্য বেইজিং বিশ্ববাণিজ্যের পছন্দ। অন্যদিকে জাপানের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি জেগে উঠলে ভারতের অত্যুৎজ্জ্বল অর্থনীতি ম্লান হওয়াটা স্বাভাবিক। তাতে তুলনামূলক বাংলাদেশে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে স্বাক্ষরিত ২৬ বিলিয়ন ডলার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে স্বাক্ষরিত ২ বিলিয়ন ডলার প্রকটভাবেই একটি প্রশ্নকে উচ্চকিত করেছে: কার অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আমাদের পরিবেশ ও ভূখ-কে সবচেয়ে বেশি ‘জাঙ্কইয়ার্ড’ বা ‘বর্জ্যক্ষেত্র’ বানাবে? আমাদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি এতসব বিপুল বিনিয়োগ ধারনে কী প্রস্তুত? চীন ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে ‘সিল্ক রোড’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীন গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ সিমেন্ট ও রড ব্যবহার করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তা ১০০ বছরেও করেনি। চীনের ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন জনসংখ্যার ৩০০ মিলিয়নই এখন ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী, যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমানসংখ্যক জনগোষ্ঠী। এমনকী শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বেশি পরিমাণ স্কলারশিপ চীন একাই বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে এক শর্তে যে চীনাভাষা শিখতে হবে। তাই চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের তাত্ত্বিক প্রাপ্তির যোগটি অঢেল হলেও কার্যত নেই। কেননা চীনের কূটকৌশল পরিপূরণের সক্ষমতা আমাদের নেই।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মোহনা। ফলে কয়েক হাজার বছরের পলিমাটিতে এ দেশ; লোকে তাই ‘পলিমাটি’র দেশ বলে, পলির মতোই মানুষের ধ্যান-ধারণা। যেমন- এক সময় পাকিস্তান বানিয়ে অন্য সময় বাংলাদেশ গড়েছে। এক সময় ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থন করে অন্য সময় বিএনপি করেছে। সম্ভবত আবহাওয়াগত দিকটিও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে চানক্য ও মনু আইনানুযায়ী উজানে বাঁধ দেওয়া নিষেধ হলেও ভারত ‘ফারাক্কা বাঁধ’ বানিয়েছে এবং অপরাপর বাঁধ নির্মাণ করে যাচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের নৈতিক অবস্থান অটুট থাকলে সে সকল বাঁধ নির্মাণ প্রতিরোধ করা যেত। তা সত্ত্বেও ভারতের পাশাপাশি চীনকে উপেক্ষার কোনো গত্যন্তর নেই বাংলাদেশের। ফলে সাবমেরিন কেনার পাশাপাশি পদ্মা সেতুর সরঞ্জামাদি চীন থেকেই নিতে হচ্ছে। এখন চীন প্রায় ৩ ঘণ্টায় মায়ানমার হয়ে ‘ঢাকা-কুনমিং’ বুলেট ট্রেন চলাচলের প্রস্তাব দিয়েছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্প। তবে চীন নিজ দেশসহ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলে ভালো হয়। তাতে চিকিৎসার্থে বাংলাদেশিরা ভারত ছাড়াও চীনে যেতে পারবে। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্যশীল। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সেই দেশপ্রেম থাকাটা অত্যাবশ্যক। সেখানেই আজকের মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সাজুয্যতা বিমূর্ত।
ইমেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স