আবুধাবির যুবরাজকে আমন্ত্রণে মোদির রাষ্ট্রনায়োকচিত ভূমিকা
রাশিদ রিয়াজ: একদিকে ইরান অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আবার কখনো ফিলিস্তিন, একই সঙ্গে ইসরায়েল। মার্কিন মুল্লুক থেকে চীনের প্রাচীর সবখানেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দেশের জাতীয় স্বার্থকেই সর্বাগ্রে স্থান দিচ্ছেন। সর্বশেষ আবুধাবির যুবরাজকে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি করে মোদি দেখিয়ে দিলেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানে ভারত জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে কিভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। এতোদিন মনে হত
পাকিস্তানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্কই একাট্টা হয়ে আছে। কিন্তু সেখানে কোনো চিড় ধরে থাকলে নরেন্দ্র মোদি ভারতের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সুযোগ নিতে পিছপা হননি।
একই সঙ্গে ইরানের ওপর অবরোধ থাকার সময় দেশটি থেকে চীনের পাশাপাশি ভারত তেল আমদানি করেছে। পররাষ্ট্রনীতিতে এধরনের সুদূরপ্রসারী কৌশলে ভারত এখন ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য, নতুন নৌপথ বিনির্মাণেই শুধু এগিয়ে যাচ্ছে না, একই সঙ্গে নতুন রণকৌশলে ভারত ও ইরান এগিয়ে যাচ্ছে, মধ্য এশিয়ার দেশ থেকে গ্যাস ও তেল পাইপলাইন অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তান, ইরান পাকিস্তান হয়ে ভারতে আসছে যা বাংলাদেশ হয়ে আসিয়ানভুক্ত দেশে একচেটিয়া জ্বালানি বাণিজ্যের পথকে খোলসা করছে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই মার্কিন চাপকে কোনো পাত্তা না দিয়েই ইরানের কাছ থেকে তেল কিনতে ভারত কখনো পিছপা হয়নি।
সর্বশেষ দেশটির প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি ছিলেন আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন যায়েদ আল নাহিয়ান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাধারণ প্রটোকল ভেঙে মুম্বাইতে গিয়ে নিজে বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান।
সামরিক কুচকাওয়াজে এই প্রথমবারের মতো অংশ নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি সেনা দল।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার বিচারে আমিরাত ক্রমেই ভারতের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। জ্বালানি তেলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আসে আবুধাবি থেকে। দুটি দেশের বাণিজ্য বেড়ে প্রায় ৬০০০ কোটি ডলারে পৌঁছে গেছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেকদিন ধরেই ভারতের বৈরি প্রতিবেশী পাকিস্তানের মিত্র। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন নিরাপত্তা নিয়েও ভারতের সাথে আমিরাতের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। তিনি বলেন, এটা সবার জানা যে এমন কিছু কিছু লোক সেদেশে থাকে যারা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ভারত মনে করছে আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ভালো হলে সুবিধা হবে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের কান্দাহারে তালেবানের হামলায় তাদের পাঁচজন কূটনীতিকের মৃত্যুতে আরব আমিরাতের সরকারের মধ্যে পাকিস্তানকে নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এমন মনোভাব জানিয়ে পিনাক আরও বলেন, আসলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে আমিরাত অনেকটা কসমোপলিটান, একটি অগ্রসর সমাজ গঠনের চেষ্টা করছে তারা.. তারা হয়তো দেখছে ভারত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দিন দিন উন্নতি করছে, স্থিতিশীল একটি গণতান্ত্রিক দেশ..।
গত এক বছরেরও কম সময়ে যুবরাজ আল নাহিয়ানের এটি দ্বিতীয় ভারত সফর।
এদিকে পাকিস্তানের মিডিয়া বলছে ইয়েমেন যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে লড়তে পাকিস্তান অস্বীকার করায় দুটি দেশের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ভারত।
ভারতের ৬৮তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে পারমাণবিক শক্তি চালিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। ইসরায়েলের কাছ থেকে পাওয়া এধরনের অস্ত্র পাকিস্তান ও চীনকে দেখিয়ে জানান দেওয়া হল যে ভারতের সামরিক শক্তি কি পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমিরাতের যুবরাজ আল নাহিয়ান দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি সুপ্রিম কমান্ডার এবং তিনি চান ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোতে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাক। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আন্ত:সীমান্ত সন্ত্রাস প্রতিরোধে কূটনৈতিকভাবে ভারত অনেকখানি এগিয়ে যাবে। বরং ভারত কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে প্রতিপক্ষকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে।
২০১৫ সালে আগস্টে নরেন্দ্র মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান তখন দুটি দেশ সন্ত্রাসে ধর্মের ব্যবহারের নিন্দা জানান। সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহারের নিন্দা জানানো হয়। সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে আন্তর্জাতিকভাবে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখার জন্যে দুই নেতা একমত হন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৬ লাখ ভারতীয় নাগরিক রয়েছেন যারা তাদের দেশে বছরে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠান।
এর আগে ভারত সৌদি আরবের বাদশাকে প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে অস্বীকার করেন। কারণ এটা ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞানের অভাব বলেই প্রতীয়মান হয়।
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ১৯৫৫ সালে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মদ। ১৯৬৫ সালে একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পাকিস্তানের কৃষিমন্ত্রী রানা আব্দুল হামিদ। এরপরই দুটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৮ সালে চীনের মার্শাল ই ঝিয়ানইং ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম দেশটির নেতা হিসেবে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। ওবামার সেই ভারত সফরের সময় মোদি তাকে নিজ হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন। ডন, বিবিসি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সম্পাদনা: এনামুল হক