কে ছিলেন প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান?
খ্রিস্টীয় দর্পণ ডেস্ক
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর দলে দলে ইংরেজ মিশনারিরা এ দেশে আসলেন। তারা খ্রিস্টের বাণী দেশীয় জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করতে লাগলেন। বাংলাদেশে শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করেই খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু হল। আঠারোশো সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা হল। ড. উইলিয়াম কেরি এর আগে, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রভৃতি পাদ্রিরা এ দেশে এসেছেন, কিন্তু ধর্মপ্রচারে উদ্যোগী হননি। শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তারা ধর্মান্তরকরণের কাজে এগিয়ে এলেন।
কোম্পানির শাসকগণ পাদ্রিদের সুনজরে দেখল না। ইউরোপে ইংরেজদের সঙ্গে নেপোলিয়নের যুদ্ধ চলছিল। তাদের ধারণা ছিল পাদ্রিরা গুপ্তচর হিসাবে নেপোলিয়নকে সংবাদ পাঠাতেন। তাছাড়া ভারতীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াও সরকারের ইচ্ছে ছিল না। ভেলোরে সিপাই বিদ্রোহকে কোনও গতিকে ঠান্ডা করা হয়েছিল। সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য ইংরেজ শাসকেরা নানা ভাবে এদেশের লোককে তোয়াজ করত। এজন্য কোম্পানির তহবিল থেকে কালীঘাটে পূজো দেওয়ার নজিরও আছে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা, নানা প্রকার কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ইংরেজ শাসনের পক্ষে বলেই খ্রিস্টের সমান অধিকারের বাণী ভারতে প্রচার নিষিদ্ধ হয়। তাই ইংরেজ এলাকায় পাদ্রিদের ঠাই হল না। তারা চলে এলেন ডেন অধিকৃত শ্রীরামপুরে।
কিন্তু এদেশীয়দের মধ্যে পাদ্রিরা প্রথম কাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন! এ সম্বন্ধে উইলিয়াম কেরির জিবনীকার পিয়ার্স কেরির সুন্দর বিবরণ আছে। কেরি ও তার বন্ধু ড. টমাস ভেবেছিলেন মুন্সি রামরাম বসু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবেন। কিন্তু রামরাম বসু তাদের সে চেষ্টাকে নিষ্ফল করে দিলেন। সবাই বলল পাষাণের বুকে হাল চাষ করে কোনও লাভ নেই। ভারতে এখনও পরিত্রাণের সময় আসেনি।
কেরি ও টমাস নিতান্ত মর্মাহত হয়ে পড়লেন। প্রথমত এবং প্রধানত তারা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে এসেছেন, কিন্তু একজনকেও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি। ‘ফকির’ নামে এক ব্যক্তি এদের কাছে খ্রিস্ট মহিমা শোনবার জন্য যাতায়াত করছিল, কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার আগেই নিখোঁজ হয়।
খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে কেরি ও টমাসকে গ্রামে গ্রামে যেতে হত। সূর্যতাপ টমাসকে মোটেই সহ্য হত না। তবু বের হতে হত। গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে টমাসের সঙ্গে বহু লোকের আলাপ হয়। টমাস তার এই অভিজ্ঞতার কথা সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। তখনকার গ্রামবাংলার অনেক চমকপ্রদ বিবরণ এতে পাওয়া যায়।
অবশেষে টমাসের সঙ্গে কৃষ্ণপাল নামে এক ব্যক্তির আলাপ হয়। কৃষ্ণপালের বাড়ি শ্রীরামপুর। আদিবাড়ি ছিল রিষড়া অঞ্চলে। উনিশ বছর বয়সে তিনি ঘোষপাড়ার রামচরণ পালের শিষ্য হন। এগারো বছর ধরে তিনি শুদ্ধাচারের সঙ্গে গুরুর আদেশ ও উপদেশ পালন করেন। কিন্তু মনে শান্তি পাননি। তিনি প্রতিদিন নিয়মিত গঙ্গাস্নান করতেন। সন্ধে-আহ্নিক করতেন।
একদিন গঙ্গাস্নান সেরে ওঠবার সময় ঘাটের সিড়িতে পড়ে গিয়ে কাধে প্রচন্ড আঘাত পান এবং কাধের হাড় ভেঙ্গে যায়। দেশীয় ডাক্তারদের দেখালেন কিন্তু কিছুই হল না। উপায় না হয়ে পাদ্রি ডাক্তারদের ডাকলেন। কেরি এবং টমাস দুজনেই ডাক্তার ছিলেন। কেরি, মার্শম্যান ও টমাস কৃষ্ণপালের বাড়ি যান। কৃষ্ণপাল আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন। পাদ্রিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কৃষ্ণপাল যীশুর প্রতি অনুরক্ত হন। কৃষ্ণের স্ত্রী রসময়ী এবং শ্যালিকা জয়মনিও যীশুতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন।
একদিন কৃষ্ণপাল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা এবং বন্ধু পাদ্রিদের সঙ্গে একত্রে ভোজন করেন। পরেরদিন শ্রীরামপুর ও পাশের এলাকায় সাড়া পড়ে যায়। লোকে দল বেধে চিৎকার করতে থাকে কৃষ্ণপাল ফিরিঙ্গি হয়েছে! স্থানীয় লোকজন কৃষ্ণপালকে ধরে নিয়ে হাকিমের কাছে যায় এবং নালিশ করে এ ব্যক্তি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একত্রে আহার করে ফিরিঙ্গি হয়েছে। একে উচিত শাস্তি দিন। তদানীন্তন ডেনিস গভর্নর কর্নেল বি সমস্ত ব্যাপারটা জানতে পারেন এবং কর্নেলের চেষ্টাতে রক্ষা পান কৃষ্ণপাল।
১৮০০ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম বাঙালি কৃষ্ণপাল খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। উইলিয়াম কেরির জিবনীকার পিয়ার্স কেরি লিখেছেন কৃষ্ণপালই বাংলাদেশ ও উত্তর ভারতের ‘প্রথম ফসল’। এ সম্বন্ধে কেরির সহচর ওয়ার্ড বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। শ্রীরামপুর মিশন চার্চের সামনে বিভিন্ন জাতীয় অগণিত জনতার সামনে উইলিয়াম কেরির পুত্র ফেলিকস কেরি ও কৃষ্ণপাল ড. কেরির দ্বারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেন। কেরি উভয়কে জলে নামিয়ে দিলেন এবং পবিত্র আত্মার নামে দীক্ষা-স্নান দান করলেন।
কিছুদিন পরে কৃষ্ণপালের শ্যালিকা জয়মনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিলেন। বাঙালি মহিলাদের মধ্যে ইনি সর্বপ্রথম এই ধর্মগ্রহণ করেন।
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর কৃষ্ণপালের উপরে যে অত্যাচার হয়েছিল তা অবর্ণনীয়। এই অঞ্চলে কৃষ্ণপাল সকলেরই সমালোচনার বস্তু হয়ে পড়লেন। তাকে মারার ষড়যন্ত্র হয়। জমিদার তাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেন এবং তার জামাতা তাকে মারধর করে অর্ধমৃত করে ফেলেন।
কৃষ্ণপাল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর তাকে ইব্রীয় বা ইউরোপীয় নাম দেওয়া হয়নি। কারণ কেরি মনে করতেন ধর্মান্তরকরণ শুধু আত্মিক উন্নতির জন্য। দেশীয় লোকদের থেকে দেশীয় খ্রিস্টানদের বিচ্ছিন্ন করা কেরির উদ্দেশ্য ছিল না। বাঙালি খ্রিস্টান সমাজে প্রথম বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণপালের কন্যা আনন্দময়ীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ কৃষ্ণপ্রসাদের। কৃষ্ণপালের বাড়ির সামনে এক গাছতলায় এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
হুগলি জেলার ইতিহাসকার এবং ঐতিহাসিক ক্রুফোর্ড সাহেব কৃষ্ণপালকে প্রথম বাঙালি খ্রিস্টপান বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় পীতাম্বর সিংহকে প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান বলে অভিহিত করেছেন। এ তথ্য সঠিক নয় বলেই অনুমান করা হয়। কারণ কৃষ্ণপাল তার দুবছর আগেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। দুবছরে আরও বেশ কিছু লোক খ্রিস্টান হয়। সুতরাং পীতাম্বর সিংহকে প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান বলা যায় না। পীতাম্বর সিংহ সম্বন্ধে যতদূর জানা যায়, যৌবন থেকেই তিনি ধর্মের প্রতি আসক্ত হন, কিন্তু কোনও ধর্মই তার মনের মত হয় না। ধর্মের জন্য তিনি ভারতের নানা স্থানে পরিভ্রমণ করেন। শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত মিশনারিদের একটি ট্র্যাকট পড়ে তিনি খ্রিস্টধর্মে অনুরক্ত হয়ে খ্রিস্টান হন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় খ্রিস্টের প্রচার করেন। ধর্মপ্রচারে তিনি কেরির সঙ্গে যান। মৃত্যুর পর মার্শম্যান প্রমুখ পাদ্রিগণ তার মৃতদেহ বহন করেন।
প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান হিসাবে কৃষ্ণপাল ইংল্যান্ডের খ্রিস্টিয় সমাজ থেকে যথেষ্ট সমাদর পান। পীতাম্বর সিংহের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। খ্রিস্টান হওয়ার পর কৃষ্ণপাল নিজেকে যথেষ্ট শিক্ষিত করে তোলেন। তিনি নিজে একজন গায়ক ও কবি ছিলেন। বাড়িতে একটা ছোট ঘরে খ্রিস্টের সুসমাচার রচনা করে তা প্রচার করতেন। উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের লোকেদের কাছে প্রচার করবার জন্য তিনি হিন্দি ভাষা শেখেন এবং ইলাহাবাদ পর্যন্ত ধর্মপ্রচার করতে যান। কৃষ্ণপাল বলতেন, ‘যীশুর কথা প্রচার করবার জন্য আমি জগতের অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত আছি।’ যশোরে ধর্মপ্রচারে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ও প্রসারে কেরির পথ তিনি প্রথম প্রস্তুত করেন।