মৃত্যু নিশ্চিত তবুও ভালবাসা দেখে মনে হয় বাঁচি : আবেদনকারী শুভমৃত্যুর আবেদনকারীর পাশে অনেকেই
বিশ্বজিৎ দত্ত ও আখতারুজ্জামান (মেহেরপুর): পরিবারসহ শুভমৃত্যুর আবেদনকারী তফাজ্জল হোসেন এই প্রথমবারের মতো যেন ভরসা পেলেন। গতকাল আমাদের মেহেরপুর প্রতিবেদকের কাছে বলেন, আমার মৃত্যু নির্ধারিত। কিন্তু মৃত্যুর আগে মানুষের ভালবাসা পাচ্ছি। এটা এখন আমার বড় পাওনা। এই ভালবাসার জন্য আবারো বাঁচতে মন চায়।
গত রোববার মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ পরিবারটিকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি তফাজ্জল হোসেনের পরিবারটিকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। নগদ ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেন। জেলা প্রশাসকের আহবানে বেসরকারি সংস্থা কনকার হাউজিং লিমিটেড ও আসলব ইন্টার ন্যাশনাল নামের একটি সংস্থা ৩০ হাজার টাকা অর্থিক সহযোগিতা করেন। ডিসি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসাপত্রগুলোর পর্যবেক্ষণ করেন এবং সুচিৎিসার জন্য তিনি বিভিন্নভাবে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বলেও জানান। মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন দোদুল ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন কিছুদিন আগে। সুযোগ পেলে পরিবারটির জন্য আরও কিছু করতে চান বলে জানান তিনি। মেহেরপুর পৌর মেয়র মোতাছিম বিল্লা মোতু পরিবারটিকে সহায়তা করবেন বলে জানান। গত ১৯ জানুয়ারি সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন মেহেরপুরের এক বাবা। তার দুই সন্তান ও এক নাতি দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত। দেশে-বিদেশে তাদের চিকিৎসা করিয়ে বাঁচানোর কোনো পথ পাননি। মেহেরপুর জেলা শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়পাড়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী জনৈক তোফাজ্জেল সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করে তার দুই ছেলে ও এক নাতির মৃত্যু ঘটানোর অনুমতি চেয়েছেন।
তোফাজ্জলের দুই ছেলে সবুর, রায়হানুল ও মেয়ের ছেলে (নাতি) সৌরভ ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রোফি নামের এমন এক রোগে আক্রান্ত এখন পর্যন্ত যার কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তারপরও চিকিৎসা করাতে ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনতে তোফাজ্জল এখন নিঃস্ব। তার চেয়েও বড় কথা হলো, তার সন্তানগণ অসুখের যন্ত্রণায় তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আর যে রোগের চিকিৎসা নেই, সে রোগ নিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন-যাপনের কোনো মানেই হয় না। ডাক্তাররা জানিয়েছে, এই রোগে তোফাজ্জেলের পরিবারের লোকজনের মাংশপেশী শক্ত হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে পরিবারটি। তবে তোফাজ্জেল হোসেনকে আশার বাণী শুনিয়েছেন ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ মেয়াদের চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। যদি সেখানে ভর্তি করা যায়। একটু আশার পথ দেখলেও অর্থসংকটের কারণে সন্তানদের চিকিৎসার পথ না পেয়ে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে তোফাজ্জেলের আবেদন হয় আক্রান্ত ছেলেদের মৃত্যুর অনুমতি অথবা চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হোক।
এ বিষয়ে জাতীসংঘে কর্মরত ডিআইজি আব্দুর রাজ্জাক ব্লগে লিখেছেন, বাস্তব কারণেই যখন বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়, তখন মানুষ জীবন থেকে মুক্তি চায়। বিত্ত-বৈভব, খ্যাতি-ক্ষমতা, কর্তৃত্ব-খবরদারিত্ব সব কিছুতেই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার নিরন্তন সংগ্রামে জয়ী হয়ে যে জীবনকে মানুষ তিলে তিলে গড়ে তোলে, হতাশা, যন্ত্রণা আর বিতৃষ্ণার কবলে পড়ে সেই জীবনকেই মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করার সহজতম যন্ত্রণাহীন পথ খোঁজে, আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের কাছ থেকে আইনি অধিকার চায়। আত্মহত্যায় সহায়তা করা অপরাধ। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এই যে মানুষ এক সময় তার জীবন থেকে মুক্তি চায়। এ মুক্তি চাওয়ার বিষয়টি অনেক সময় ধর্মীয় আচারের মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের মুসলমানরা গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের হয় মুক্তি, নয়তো মৃত্যুর জন্য দোয়া করে, খাজে খতম কিংবা ইউনুস খতম করে। উন্নত বিশ্বে জীবনের একটি পর্যায়ে জীবন থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেওয়ার জন্য আত্মহত্যা করা কিংবা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ডাক্তার কর্তৃক মরণঘাতী ওষুধ প্রয়োগের অধিকার আদায় করার জন্য অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন আন্দোলন পর্যন্ত করে। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর হলেও জীবনকে স্বেচ্ছায় নষ্ট করার কিংবা এ কাজে সহায়তা করার কাজের আইনগত স্বীকৃতি কোনো কালেই বিতর্কহীন ছিল না, এখনও নেই।
রোগযন্ত্রণা বা দুঃখ-কষ্ট হতে অব্যাহতির জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে আত্মহত্যা বা মরে যাওয়ার বিষয়টিকে বলা হয় ইউথ্যানাশিয়া, যার বাংলা প্রতিশব্দ বা পরিভাষা হতে পারে শুভমৃত্যু এই ইউথ্যানাশিয়াকে এখন অনেকে ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে দাবি পর্যন্ত করছে। শান্তিপূর্ণ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার আদায়ের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে নানান প্রকারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা নানাভাবে, নানা যুক্তি দেখিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আবেদন করছেন এবং অনেকক্ষেত্রে বাধ্য করছেন যে রোগ-শোকে মুহ্যমান আদম সন্তানের যখন আর সুস্থ জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না, অথচ অমানবিক যন্ত্রণায় সারাক্ষণ তারা নিজে যেমন দগ্ধ হচ্ছেন আর অন্যদেরও দগ্ধ করছেন, তাদের সেই অভিশপ্ত জীবনকে ধ্বংস করাই মানবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের গড়পড়তায় এখনো বোঝানো সম্ভব হয়নি। তাই তো পৃথিবীর নগণ্য সংখ্যক কিছু রাষ্ট্র ভিন্ন অন্য কোথাও ইউথ্যানাসিয়া বা শুভমৃত্যুর অনুমতি নেই। তারপরও এ মুহূর্তে পৃথিবীর অন্তত চারটি দেশ- নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও কলম্বিয়ায় পুরোপুরিভাবে ইউথানাশিয়া বৈধ রয়েছে। এর বাইরেও জাপানসহ আরও চারটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ছয়টি অঙ্গরাজ্যে ডাক্তারদের সহয়তায় ইউথ্যানাসিয়াকে বৈধ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউথ্যানাসিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হলো স্বেচ্ছামৃত্যু। এখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজে কিংবা তার ডাক্তারের সহায়তায় চেতনানাশক প্রাণঘাতি ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুকার্যকর করে। অনিচ্ছা প্রসূত শুভ মৃত্যুতে ব্যক্তির সম্মতি দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। যেমন কোমায় যাওয়া কোনো রোগীর মৃত্যু ঘটানোর সিদ্ধান্ত চিকিৎসকগণ কিংবা তার আত্মীয়-স্বজনরাই নিয়ে থাকে। অন্যদিকে বাধ্যকৃত শুভমৃত্যু আদালতে আদেশে কিংবা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম