শুরুতেই ধাক্কা খেলো ট্রাম্পের মুসলিম নিষিদ্ধের পরিকল্পনা
কামরুল আহসান: ২৮ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে সিরিয়ার শরণার্থীদের পরবর্তী নির্দেশ দানের আগ পর্যন্ত আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পাশাপাশি ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন এ ছয়টি দেশ থেকে আসা কোনো মানুষ ৩ মাস যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবে না বলে নির্দেশে জানান।
তার এই নির্দেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। মার্কিন ডেমোক্রেট দলের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন এই নির্দেশের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে জানান, এটা আমেরিকার মূল্যবোধের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। প্রতিবাদ করেছেন আমেরিকার তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, ‘এটা আমাদের আমেরিকা নয়, আমাদের আমেরিকা বন্ধুত্বের ও সহমর্মিতার’। আ্যাপেলের নির্বাহী পরিচালক টিম কুক বলেছেন, ‘সত্যিই যদি এরকম হয় তাহলে অ্যাপেল টিকবে না। কারণ অ্যাপেলের বেশিরভাগ কর্মচারীই অভিবাসী মুসলিম’। গুগলও তাদের বহিরাগত মুসলিম কর্মকর্তাদের দ্রুত আমেরিকায় ডেকে নিয়ে গেছে। তারা সবাই একই উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে যে এই আদেশ আমেরিকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ক্ষেত্রে ভয়াবহু হুমকি নিয়ে আসবে, আর স্পষ্টই আমাদের মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরি করবেন।
নির্দেশটি জারি হওয়ার পর শুক্রবার রাতেই জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে কয়েকজন মুসলিমকে আটকে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিল দুজন ইরাকি শরণার্থী। সঙ্গে সঙ্গে কেনেডি বিমানবন্দরে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে যাত্রীরা। শনিবার সারাদিন ধরে কেনেডি বিমানবন্দরে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভে অংশ নেয় শত শত মানুষ। নানা দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয় নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ড্রাইভাররা। কারণ, তারা বেশির ভাগই অভিবাসী। তাদের বক্তব্য, আমাদের বন্ধুদের এখানে ঢুকতে দিন। অভিবাসীদের এখানে স্বাগতম। কোনো ভয় নেই, ঘৃণা নেই। ‘নো ব্যান, নো ওয়াল’ প্লেকার্ড লিখে বুকে ঝুলিয়ে তারা সেøাগান দিতে থাকে। নিউইয়র্ক ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সংগঠন এফটি এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সংগঠনের একজন মুখপাত্র জানান, আমাদের সংগঠনের ১৯ হাজার সদস্য নৈতিকভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে। কারণ এখানে যারা ট্যাক্সি চালায় তাদের বেশির ভাগই অভিবাসী মুসলিম। যাই ঘটুক, আমরা এক সঙ্গে থাকবো। কেনেডি বিমানবন্দরের চার নাম্বার টার্মিনাল থেকে সমস্ত ট্যাক্সি ড্রাইভার ত্যাগ করেছে। এই আইন উঠিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা কোনো যাত্রী বহন করবে না। বিমানবন্দর থেকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে। এর মধ্যে আরও সাতটি বিমানবন্দরে মুসলমান যাত্রীদের আটকে রাখা হয়।
যদিও ট্রাম্পের নির্দেশে স্পষ্ট করে ঢালাওভাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের উল্লেখ করা হয়নি। মুসলিমপ্রধান সাতটি দেশের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আর সিরিয়ার শরণার্থীদের উপরই তিনি অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, যেসব সিরিয়ান শরণার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করবে তাদের মধ্য থেকে ভবিষ্যতে খ্রিস্টানদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর আগে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ১০ হাজার সিরিয়ান শরণার্থীকে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনি প্রচারের সময়ই ট্রাম্প আমেরিকায় মুসলিম অভিবাসীদের আসা ঠেকাবেন এই রকম হুঁশিয়ারি জারি করেছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আর সেরকম কিছু বলেননি। হঠাৎ করেই তিনি শুক্রবার এই নির্বাহী আদেশ জারি করেন। যা তাৎক্ষণিকভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমলোচনার জন্ম দেয়। ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছেন, এটা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণার মতো এবং এই নির্দেশ মুসলিমদের প্রতি বিতৃষ্ণারই বহিঃপ্রকাশ।
ট্রাম্পের নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শরণার্থীদের নিজ দেশে স্বাগত জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। টুইটারে জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেন নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা কানাডায় স্বাগতম। বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি। ‘ওয়েলকাম টু’ হ্যাশট্যাগ চালু করে তিনি বলেন, আপনাদের জন্য কানাডার দরজা খোলা।
কিন্তু এ নির্দেশটি সরাসরি মুসলিমদের বিরুদ্ধেই আঘাত বলে দেখছেন সবাই এবং নির্বাচন সময়কালীন ট্রাম্প যে মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়েছেন তারই প্রতিফলন দেখছেন এখন।
তবে নির্বাহী আদেশটি জারি করার দুদিন পরই ট্রাম্প ভয়াবহ এক ধাক্কা খেলেন। সব প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখেই বৈধ ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্টে পৌঁছানোর পরও মুসলিমপ্রধান কয়েকটি দেশের নাগরিকদের বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল দেশটির কর্তৃপক্ষ। তখনই শনিবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে আমেরিকার সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন বা এসিএলইউ। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে নিউইয়র্কে স্থানীয় এক আদালতের বিচারক স্থানীয় সময় শনিবার রাতে এ স্থগিতাদেশটি দেন। আবেদনটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্রাম্পের অভিবাসী সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশ আপাতত স্থগিত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জেলা জজ আদালতের বিচারক অ্যান ডানলি এই আদেশটি দেন। ফলে যারা বৈধ ভিসা নিয়ে আসছে, যাদের কাছে কর্তৃপক্ষ আনুমোদিত শরণার্থীর আবেদনপত্র আছে বা যেসব অভিবাসী বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে চাইছে তাদের প্রবেশে আর বাধা দেওয়া যাবে না। এসিএলইউ বলছে, আদালতের এই আদেশের ফলে নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে আটক ব্যক্তিরা মুক্তি পাবেন।
ট্রাম্প যে এরকম কিছু করতে পারেন তা তার প্রচারণার সময় থেকেই আঁচ করতে পারছিল মার্কিন আইনজীবীরা। তাই তারা আগেই ভেবে রেখেছিলেন, চাইলেই ট্রাম্প যা খুশি করতে পারবেন না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রবেশ করতে পারবে আর দেশটির নাগরিত্ব কে পাবে এটা নির্ধারণ করে কংগ্রেস আর হোয়াইট হাউস। আর দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কখনো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি যে ধর্মের ভিত্তিতে কেউ নাগরিত্ব পাবে না, বা অন্য কারও চেয়ে অধিকারে পিছিয়ে থাকবে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে ধর্ম যৌক্তিক পরিচয় নয়।
আমেরিকার অভিবাসীয় অধিকার প্রকল্পের আইনবিষয়ক উপ-পরিচালক লি গেলার্ন্ট আদালতে অভিবাসীদের পক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। এ সময়ের আদালতের বাইরে অনেকে তাকে সমর্থন জানান। গেলার্ন্ট উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এসে কেউ যেন আটকে না পড়ে আদালত সে ব্যবস্থা করবে।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে এই মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত ট্রাম্পের নির্দেশটি স্থগিত থাকবে। আর তাই বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আদালতের কাছে হেরে গেলেন। এটাকে তার নৈতিক পরাজয় হিসেবেই দেখছে সবাই। নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটা তার জন্য বড় একটা শিক্ষা। মানসিক ধাক্কা। এরপর চাইলেই আর যা খুশি তিনি বলতে পারবেন না। একটা নির্দেশ জারি করার আগে দশবার ভাববেন। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান ও অন্যান্য সংবাদপত্র