মুসলিম অভিবাসী নিষিদ্ধে ইহুদি-খ্রিস্টানরা সরব, নিশ্চুপ কেন সৌদি বাদশাহ?
রাশিদ রিয়াজ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের অভিবাসী হিসেবে তার দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দেশটিতে যারা তীব্র প্রতিবাদ করছেন তাদের মধ্যে ইহুদি ও খ্রিস্টান নাগরিকরা রয়েছেন। তাদের হাতে প্লাকার্ডে লেখা, ‘আমরা ইহুদিরা মুসলিম অভিবাসী নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে’, ‘আমরা খিস্টান, অভিবাসী বাতিল মানি না’, ‘কেউ মুক্ত নয়, যখন অন্যরা নির্যাতিত’, ‘আমেরিকা গড়ে তুলেছে অভিবাসীরা’।
যে সাতটি মুসলিম দেশের অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভৌগলিক মানচিত্রে সেসব দেশের পাশেই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব, মিসর ও তুরস্ক। বলা যায় ট্রাম্পের দৃষ্টিতে বিপদজনক মুসলিম দেশগুলো ঘিরে রেখেছে সৌদি আরব ও মিসরকে। মানচিত্রে দেখা যায় সিরিয়া, ইরাক, ইরান, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেন ও লিবিয়া চারপাশ থেকে অবস্থান করছে সৌদি আরবকে মাঝখানে রেখে। এসব দেশে আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, আল-শাবাব এর নামে যেসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে তার মিত্র দেশ সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহাযোগিতা রয়েছে। অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে যে জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব শান্তিপ্রিয় অন্যান্য মুসলিম দেশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
এছাড়া সৌদি আরব নিজেকে মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক মনে করে। দুই পবিত্র মসজিদের ‘হলি কাস্টডিয়ান’ হিসেবে সৌদি বাদশাহ নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকেন। মুসলিম দেশ থেকে লাখ লাখ মুসলমান প্রতিবছর হজ করতে যায়। এমন প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনো দেশের সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসের জন্যে অভিযোগ বা প্রমাণসাপেক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের অভিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি বাতিল করেননি। আজকে ট্রাম্প ৭টি দেশের মুসলিম অভিবাসী নিষিদ্ধ করছেন, ভবিষ্যতে আরও মুসলিম দেশের অভিবাসীদের ইচ্ছেমত একই তালিকায় ফেললে এর খেসারত কে দেবে? এসব বিষয় নিয়ে কোনো বোধদয় নেই সৌদি বাদশাহ ও তার মিত্রদের। যুক্তরাষ্ট্র গড়েই উঠেছে অভিবাসীদের ঘামে, রক্তে, মেধায় ও পরিশ্রমে। আজ কেন তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে, এই সহজ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করার মত ফুরসত নেই সৌদি বাদশাহর।
প্রশ্ন উঠতে পারে কেন সৌদি বাদশাহকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশ এমনকি ইসরায়েলের ওপরও প্রভাব বিস্তারকারী দেশ। এসব দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও পণ্য কেনে সৌদি আরব। সৌদি আরবের তেলের ওপর নির্ভর করেই পরাশক্তিগুলোর সভ্যতা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার পাটাতন গড়ে উঠেছে। আর সেই সৌদি বাদশাহ মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণায় নিশ্চুপ থাকবেন কেন? যুক্তরাষ্ট্রের আদালত পর্যন্ত ট্রাম্পের এ ঘোষণা সাময়িক স্থগিত করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পর্যন্ত নিন্দা জানিয়েছেন। কারণ যেসব অভিবাসীকে আজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তারা বছরের পর বছর ব্যবসা করছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন আর এখন তাদের এক কাপড়ে বের হয়ে আসতে হবে, ঢুকতেও পারবেন না যুক্তরাষ্ট্রে?
ইহুদিরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কারণ তাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে অতীতে তারা জানে এ ধরনের অভিবাসী নিষিদ্ধের মানে কি? খিস্টানরাও মানবিক কারণে ট্রাম্পের নীতির কড়া সমালোচনা করে প্লাকার্ড হাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে নেমে এসেছে। কিন্তু মুসলমান হয়ে সৌদি বাদশাহ এখনো চুপ কেন? কেন পবিত্র মসজিদের গ্রান্ড মুফতি কেন কোনো বিবৃতি দিচ্ছেন না।
তর্কের খাতিরে যদি বলা যায়, ট্রাম্প মুসলিম অভিবাসী নিষিদ্ধ না করে ইহুদি, খ্রিস্টান,বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিবাসীদের যদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেন তাহলে ইসরায়েল কিংবা ভ্যাটিকানের পোপ কি নিশ্চুপ থাকতে পারতেন? আদতে দেখা যাচ্ছে এতদিন বিশ্বের কাছে আইএস নামে যে ইসলামিক স্টেটের পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা আসলে ইসরায়েলি স্টেট হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর সীমানা কেড়ে নিয়ে ইসরায়েলের আকার আরও বড় করার একটা বন্দোবস্ত ছিল। রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর কারণে তা সম্ভব হয়নি। বুঝে হোক না বুঝে হোক এতদিন মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের জন্যে বিদ্রোহী ও আইএস জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দিন কয়েক আগে দাভোসে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন পৃথক দুই রাষ্ট্র নিয়ে ফ্রান্সের আলোচনা উদ্যোগের কড়া প্রতিবাদ করে বলেন, নতুন বিশ্ব দেখবে দুনিয়া। নেতানিয়াহুর সেই পরিকল্পনা অনুয়ায়ী কি ৭ মুসলিম দেশকে বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করে এসব দেশের অভিবাসী নিষিদ্ধ করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অতঃপর ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু এ সাতটি মুসলিম দেশকে ঘিরে আগামী পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়িত করতে নানা ছক কষেন তাই দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ব কি ভুলে গেছে তথাকথিত মাস ডিস্ট্রাকশন উইপনের খোঁজে ইরাকের কি হাল করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। আরব বসন্তের নামে লিবিয়ার কি হাল হয়েছে তাও সাক্ষী আছে মুসলিম বিশ্ব। সুদানকে কিভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিভাবে নাইজেরিয়ার তেল সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে? আসলে মুসলিম বিশ্ব বলে কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে? না আছে গণতন্ত্র, বরং রাজতন্ত্র, স্বেচ্ছাচার, দুুর্নীতি, অযোগ্যতা, প্রযুক্তিবিমুখ শাসকগোষ্ঠী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে মুসলমানদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন দেশে দেশে। তাদের জাতিসংঘ থেকেও নেই। তাই ট্রাম্পের দৃষ্টিতে আপাতত ৭টি দেশ বিপদজনক মনে হলেও অদূর ভবিষ্যতে এই তালিকায় আরও মুসলিম দেশগুলোর নাম জড়িয়ে যাবে কি না তা আগামী দিনের ভূকৌশলগত রাজনীতির কলাকৌশল বলে দেবে।
বরং বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম দেশকে এ ধরনের ভূ-কৌশলগত রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশ থেকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের পরিস্থিতি কোন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে যায় বা পরাশক্তিগুলো এ ধরনের সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে মানচিত্র পরিবর্তনের নতুন ছক কষে কি না যা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানতে পারে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অভিবাসীদের উপর কোনো চাপিয়ে দেওয়া বিধি যৌক্তিক না হলে, আইনগত বৈধতা না থাকলে তার বিরোধিতা করতে হবে। কারণ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে বাস করছে। ভবিষ্যতে অন্যদেশের মতো তাদের উপর অকারণে এমন কোনো ঢালাও অভিযোগ আনা হলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এজন্যে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে হবে সচেতনভাবে।