ক্যুইবেকে গুলিতে নিহত ৬, নিউ জার্সিতে ক্যাথলিক বিশপের উপর হামলা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে মসজিদ হামলা
পরাগ মাঝি, এম রবিউল্লাহ এবং টরন্টো থেকে মোহাম্মদ আলী বোখারী : যুক্তরাষ্ট্র ও এর প্রতিবেশী দেশ কানাডায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর হামলা হয়েছে। কানাডার ক্যুইবেক সিটির মসজিদে গতকাল আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে ক্যাথলিক বিশপের উপর হামলা করেছে এক দুর্বৃত্ত। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে শনিবার পুড়িয়ে দেওয়া মসজিদ পুনর্নির্মাণে মুসলমানদের পাশাপাশি অর্থ দিচ্ছে ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি নাস্তিকরাও। গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরপরই এসব ঘটনা ঘটেছে ।
কানাডার ক্যুইবেক সিটির সেন্ট ফয় ইসলামিক কালচারাল সেন্টার মসজিদে আততায়ীর গুলিতে ৬ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। গত রোববার মাগরিবের নামাজ আদায়কালীন এ ঘটনাটি ঘটে। এতে দ্রুতই সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেফতার করা গেছে বলে জানিয়েছে ক্যুইবেক প্রাদেশিক পুলিশ। এ ঘটনায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ক্যুইবেক প্রদেশের প্রিমিয়ার ফিলিপ কুলিয়ার্ড ও সিটি মেয়র রেজিস লেবিওম পৃথকভাবে গভীর শোক প্রকাশসহ নিন্দা জানালেও দেশটির জননিরাপত্তা মন্ত্রী রাল্ফ গোদেলের দফতর থেকে ঘটনার উদ্দেশ্য সর্ম্পকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। বর্তমানে মসজিদটি সন্ত্রাস দমন টাস্ক ফোর্সের রাষ্ট্রীয় পুলিশ আরসিএমপি, প্রাদেশিক পুলিশ ও মন্ট্রিয়ল পুলিশ ঘিরে রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার নিন্দা বার্তায় নিহত-আহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন, এটি একটি হৃদয়বিদারক ও কা-জ্ঞানহীন সন্ত্রাস। বহুজাতিকতা আমাদের প্রাণশক্তি ও ধর্মীয় সহনশীলতা আমাদের মূল্যবোধ। মুসলিম কানাডিয়ানরা কানাডার সংস্কৃতির মূল্যবান ভূষণ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিটি নাগরিকের জীবনরক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট ও বদ্ধপরিকর।
তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী রেডিও কানাডাকে জানিয়েছেন, ‘স্কি মাস্কে’ আবৃত দুজন ভারি কণ্ঠের ক্যুইবেকভাষী উচ্চকণ্ঠে গালাগাল দিয়ে নামাজ আদায়কারীদের ওপর গুলি ছোড়া শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই ৫ জন মারা যায় এবং অন্যরা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তা না জানালেও বলেছেনÑ তার পাশের জনকে পড়তে দেখে তিনি নিজেও লুটিয়ে পড়েন। প্রাদেশিক পুলিশের মুখপাত্র ক্রিস্টিন কলোম্বী জানিয়েছেন, যারা ওই সেন্টারে আততায়ীর গুলিতে নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের বয়স ৩৫ থেকে ৭০ হবে। এ ছাড়াও ৩৮ জন মুসল্লি ছিলেন, যারা কোনো আঘাত পাননি। সন্দেহভাজন দুজন পুরুষকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, যাদের একজন মসজিদের কাছাকাছি এবং অপরজন ডাউনটাউন ইল ডি অরলিন্সে ছিল। কিন্তু পুলিশের এই মুখপাত্রও বলেননি, তারা কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
জানা গেছে, এর আগেও মসজিদটি ভাঙচুরসহ দরজায় ‘শূকরের মাথা’ রেখে যাওয়ার মতো ঘটনার শিকার হয়েছে। মসজিদের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াংগুয়ি টিভিএ নভোলিসকে বলেছেন, সাধারণত: রোববারের মাগরিবের জামাতে ৬০ থেকে ১০০ জন অংশ নেয়। ওই ইসলামিক সেন্টারের ফেসবুকে সংযোজিত ‘লাইভ ভিডিও’ ক্লিপে দেখা গেছে আহতদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির ব্যস্ততা। ক্যামেরার পেছনে একজন বলছেন, ‘লোকটি দৌড়ে পালিয়েছে’। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলছেন, ‘এটা ট্রাম্পেরই ফসল’।
শুক্রবারই এক নির্বাহী আদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় ২১ কোটি মানুষের দেশ ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেনের জনগণকে ১২০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এ ছাড়াও সিরীয় উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয় নিষিদ্ধ করেছেন। এগুলো সবই ছিল তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে ক্যাথলিক বিশপ ম্যানুয়েল এ ক্রুজের উপর হামলার সময় তিনি বেদিতে বসে বেসবল খেলা দেখছিলেন। এসময় এক দুর্বৃত্ত বেদিতে উঠেই ক্রুজের মুখে ঘুষি মারতে থাকেন। অসুস্থ ক্রুজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, আক্রমণকারীর নাম চার্লস মিলার (৪৮), তিনি নিওআর্কের বাসিন্দা। তবে মিলার কেন বিশপ ক্রুজকে আক্রমণ করেছেন তা জানায়নি পুলিশ।
নিউ জার্সির নিওআর্কের আর্কডিওসিসের অতিরিক্ত বিশপের দায়িত্ব পালন করছেন ৬৫ বছর বয়সী ক্রুজ। তাকে আক্রমণের দৃশ্যটি অন্তত ৭৫ জন দেখেছে। এ ঘটনায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। বেদিতে পরে যাওয়া পর্যন্ত ক্রুজকে মারতে থাকেন মিলার। তাপিনতো ডট নেট ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
এসেক্স কাউন্টি শেরিফ অফিস জানিয়েছে, আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বেদির দিকে দৌড়ে গিয়ে আক্রমণকারী মিলারকে আটক করা হয়।
বেসবল খেলাটির আয়োজন করা হয়েছিল বেসবলের গ্রেট খ্যাত রবার্তো ক্লিমেন্তির সম্মানে। ভূমিকম্প দুর্গতদের সহায়তা করতে গিয়ে নিকারাগুয়ায় ১৯৭২ সালে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ক্লিমেন্তি।
নিওআর্কের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও বেসবল খেলার আয়োজক লুইস কুইনটানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি বুঝতে পারছি না মিলার কেন বিশপ ক্রুজকে আক্রমণ করলেন। সে নির্বোধের মতো আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা সবাই ক্রুজের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।
আঘাতের কারণে ক্রুজের কয়েকটি দাঁত হারাতে হতে পারে। তবে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে নিওআর্ক স্টার লিগারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রুজের অবস্থা গুরুতর নয়। নিওআর্কের আর্কডিওসিসের মুখপাত্র জেমস গুডনেস বলেন, আমাদের কোনো চার্চে এই ধরনের ঘৃণ্য হামলা হতে পারে তা আমরা ভাবতেই পারি না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে পুড়িয়ে দেওয়া মসজিদ পুনর্নির্মাণে মুসলমানদের পাশাপাশি অর্থ দিচ্ছে ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি নাস্তিকরাও। এর আগে এটি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল মুসলমানরা। মসজিদটি নির্মাণে তারা সম্ভাব্য ব্যয় ধরেছিল সাড়ে ৭ লাখ ডলার। এই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের জন্য তহবিল গড়ার উদ্যোগ নেওয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ৬ লাখ ডলারেরও বেশি যোগাড় হয়ে গেছে। তহবিল সংগ্রহে গণচাঁদার মাধ্যমে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদি, খ্রিস্টান ও নাস্তিকরাও অংশ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার ৭টি মুসলিম দেশের শরণার্থীদের প্রবেশ ও নাগরিকদের ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার পর সেদিনই রাত ২টায় দক্ষিণ-পূর্ব টেক্সাসের ‘ভিক্টোরিয়া ইসলামিক সেন্টার’ নামের মসজিদটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায় ২০০০ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামিক সেন্টারের প্রেসিডেন্ট শহীদ হাশমি বলেন, শনিবার সকালে আমরা খুব দুঃখ পেয়েছিলাম যখন দেখলাম মসজিদটি পুড়ে যাচ্ছে। তবে মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য অভূতপূর্ব আর্থিক সাড়া পাওয়ার পর তিনি বলেন, আমরা অভিভূত, কৃতজ্ঞ।’
‘গো ফান্ড মি’ ওয়েবসাইটে তহবিলের আবেদন জানালে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬ লাখ ডলার গণচাঁদা পাওয়া যায়। ওয়েবসাইট পেইজে দেখা গেছে, অর্থদাতাদের মধ্যে মুসলমানদের পাশপাশি অনেক ইহুদি, খ্রিস্টান ও নাস্তিক ব্যক্তিও রয়েছেন।
ইহুদি বংশোদ্ভূত বেঞ্জামিন টাম্বার রোজেনাউ নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণে ১০০ ডলার দিয়ে লিখেছেন, ইহুদিরা যেমন ইউরোপে আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলমানরাও অমূলক ঘৃণার শিকার হচ্ছে। এমনকী এমন ঘৃণ্য কাজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ সরকারের বড় অংশ সহযোগিতা করছে।
মার্টিন ওয়াগনার নামে আরেকজন লিখেছেন, আমি একজন খ্রিস্টান। মুসলমানদের সঙ্গে যা হচ্ছে তাতে আমি কষ্ট পেয়েছি এবং হতাশ হয়েছি।
হাশমি আশাবাদ জানিয়ে বলেন, ইনশাল্লাহ আগামী রমজান আমরা নতুন মসজিদেই পালন করব। সূত্র : ফক্স নিউজ, আল জাজিরা