বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ভাষা নিয়ে আমাদের সেই গর্ব সেই অহংকার আজ নেই
আশিক রহমান: বাংলা ভাষার ব্যবহার, মর্যাদার কথা বলতে গেলে হতাশার কথাই বলতে হয়। আমরা বলে থাকি, পৃথিবীতে একমাত্র অথবা অতিশয় বিরল একটি মাত্র রাষ্ট্র, যার ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। বাংলা হচ্ছে এ রাষ্ট্রের মূল ভাষা। এতটা বিশুদ্ধভাবে একটা বিশেষ ভাষাকে অবলম্বন করে একটি রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে, এর নজির পৃথিবীতে নেই। আজ সেই ভাষা নিয়ে আমাদের সেই গর্ব, সেই অহংকার নেই।
দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বাংলাসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি বলেন, এ রকম নজির যেমন পৃথিবীতে নেই, আবার এ রকম একটা অর্জনের পরেও সেই ভাষাটা নিয়ে আমরা শুধু গলাবাজি করেছি। কিন্তু ভাষার জন্য আমরা তেমন কিছু করিনি। বাংলা একাডেমিতে অল্পকিছু কাজ হয়েছে, তাছাড়া আর বিশেষ কিছু হয়নি।
এই সাহিত্যিক বলেন, বাংলা ভাষাকে যে খুব সম্মান করা হয় তাও এখনো পর্যন্ত আদালতে, রায় লেখাতে, সুপ্রিম কোর্টের বিচার ব্যবস্থায়, সচিবরা নোট দেন। সেখানে এক বা আধ লাইন লিখতে হয়। অথবা ইংরেজিতেই লেখা হয়। গোটা বাংলাদেশের কথা ছেড়ে দিলাম, শুধু ঢাকা শহরে যে অজস্্র দোকান রয়েছে, তাদের সাইনবোর্ড কোন ভাষায় লেখা আছে? বাংলা অক্ষরে ইংরেজি অথবা সরাসরি ইংরেজি অক্ষরে লিখেছে, কেউ কেউ বাংলা লিখেছে। এই জায়গাটিতে রাষ্ট্রের একদম হস্তক্ষেপ দরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে হাসান আজিজুল হক বলেন, বাংলা ভাষা অর্জন করেছি বটে, কিন্তু তার মর্যাদা রাখতে পারিনি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ঢুকিয়ে দিতে পারিনি। ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারিনি। এত বড় একটা রাষ্ট্রভাষা, তার মর্যাদা আমরা রাখতে পারিনি, তাহলে অন্যান্য ভাষার বেলায় কী হবে? সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে। এসব ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের ভাব কি হওয়া উচিত? তুচ্ছতাচ্ছিল্য করব? নাকি যথেষ্ট সম্মান করে এ সমস্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে, নিজস্ব ভাষাকে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব। কোনটা আমাদের করা উচিত সেটা বুঝতে হবে?
তিনি বলেন, চীনে একটা ইংরেজি জানা লোক নেই। আমার এক মেয়ে চীনে থেকেছে। সে বলে, চাচাÑ বাইরে গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলার উপায় নেই। ওদের ভাষাও তো আমরা জানি না। আমার ছেলে গিয়েছিল জাপানে। সেখান থেকে ও ডিগ্রি অর্জন করে এসেছে। সে বলল, ওখানে ইংরেজি কেউ জানে না। নিজের ভাষা নিয়ে ওদের মধ্যে অনেক অহংকার। ইংরেজি জানে না বলে কি ওরা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পিছিয়ে আছে? চীন কি যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে পড়ে আছে, তা তো নেই। কাজেই যারা মনে করেন ইংরেজি স্ট্যাটাস একটা সিম্বল বা ইংরেজি বলতে পারলে আমার আভিজাত্য প্রকাশ হয়ে গেল, অথবা আমি উচ্চ শ্রেণির লোক হয়ে গেলাম!
তিনি আরও বলেন, আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, জার্মানির ফ্রাঙ্কফোর্ডে জিজ্ঞেস করেছিলাম ইংরেজিতে, যে ওমুক পাড়াটা কোথায়? তখন তারা বলল, ইংরেজি জানি, কিন্তু আমরা কেউ ইংরেজিতে কথা বলব না। নিজের ভাষা নিয়ে ওরা অনেক গর্ব করে। কিন্তু ভাষা নিয়ে আমাদের সেই গর্ব নেই, সেই অহংকার নেই। সম্পাদনা: উম্মুল ওয়ারা সুইটি