বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চা ধর্ম নিরপেক্ষ-গণমুখী হতে হবে
প্রিয়াংকা আচার্য্য: গত শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারায় শুরু থেকেই এক ধরনের দ্বিধা কাজ করেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। আর দ্বিধাটা কি নিয়ে এর উত্তরে তিনি বলেন, প্রথমত বাংলা ভাষায় আবার ইতিহাস লেখা যায় কিনা। দ্বিতীয়ত যদি লেখা যায় সেক্ষেত্রে যিনি লিখবেন ঐতিহাসিক হিসেবে তার মর্যদা ক্ষুণœ হবে কিনা। কেননা একসময় বাংলাভাষাকে ঐতিহাসিকগণ মর্যাদাসম্পন্ন ভাষা মনে করতেন না। তাদের ধারণা ছিল ইংরেজি ভাষায় ইতিহাস লেখা হলে তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। ফলে অনেকটা সাহেবি কায়দা বেছে নিয়েছিলেন আমাদের অগ্রজ ঐতিহাসিকরা।
আপনারা জেনে অবাক হবেন, ভাষা আন্দোলন বা ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের সময় যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বলিষ্ঠরূপে উন্মেষ ঘটেছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ বাংলা ভাষায় ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধ করে এবং তৎকালীন ইতিহাস পরিষদও এর সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে। এ অবস্থায় বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এগিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাস বিভাগ। এই বিভাগের বিজ্ঞ শিক্ষক এবিএম হাবিবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তালুকদার এবং ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক এএফ সালাউদ্দীন আহমেদের মতো প-িতবর্গ ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার দাবি তোলেন। ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের ইসলামি ইতিহাস বিভাগ বাংলা ভাষায় ইতিহাস লেখার দাবিটা সত্যি এক দারুণ ইতিহাস।
১৯৬৮ সালে এবিএম হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বে ‘ইতিহাস’ নামে একটি পত্রিকা চালু হয়। এক্ষেত্রে আরেকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি সাহিত্যের মানুষ হয়েও বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী গ্রন্থ লিখেন। তিনি হলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যে ক্ষীণ ধারা এই প্রাজ্ঞজনরা চালু করেন তাই বেগবান হয় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। একের পর এক গ্রন্থ লিখে তিনি বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার দিক সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহরকে জানতে গেলে আশির দশকে তার রচিত গ্রন্থগুলো নিশ্চিতভাবে সাধারণ পাঠককে বেশ উপকৃত করে। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্য দিয়েই এদেশে ইতিহাস পাঠ বিজ্ঞজনের বাইরে সাধারণ মানুষের পাঠ্য হয়। তিনি এ সকল গ্রন্থ বাংলায় লিখেছেন বলে ইতিহাস চর্চা জনমানুষে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তবে তারও আগে ষাটের দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল করিম প্রথমে ঢাকায় মুসলিম নিয়ে পরে বাংলার ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন। এ ধারায় পরবর্তীতে যুক্ত হয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম লিখলেন উপনিবেশ শাসন কাঠামো নিয়ে। এরপর অবশ্য আরও অনেকে পরে যুক্ত হয়েছেন।
তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে ইতিহাস পরিষদ। সেই সাথে বাংলা একাডেমিও বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এটিও উল্লেখযোগ্য যে তাদের আরও ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। আরেকটি প্রতিষ্ঠান যা খুব পরিচিত নয় কিন্তু বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। আইসিবিএস (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিস) নামের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুনতাসীর মামুন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি, জার্মান ও ওলন্দাজ ভাষা থেকে বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়। এরপর নাম নিতে হয় এশিয়াটিক সোসাইটির। যদিও প্রতিষ্ঠার অনেক পরে তারা বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার কার্যক্রম শুরু করে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী নামে আরেকটি সংগঠন এক্ষেত্রে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এদেশের প্রত্যেক ছাত্র যে বিভাগেই পড়–ক না কেন তাকে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবশ্যই পাঠ করতে হবে এমন সেøাগান নিয়ে এ সংগঠনটি কাজ করছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এমন প্রায় এক হাজার স্থান চিহ্নিত করেছে এবং প্রত্যেকটি স্থান ধরে ধরে ইতিহাস রচনার কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার ধারা কয়েকভাবে ভাগ করা হলে দেখা যাবে এর প্রধান ধারাটি রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার। অর্থাৎ রাজবংশের ইতিহাস যা মূলত ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছিল। এরপর বাংলা ভাষায় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উঠে আসল নতুন এক ধারা যেখানে রাজনৈতিক বৃত্তকে ভেঙে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা শুরু করলেন ঐতিহাসিকেরা। এক্ষেত্রে পথিকৃৎ হলেন জাতীয় অধ্যাপক এএফ সালাউদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। আর এই ধারার মূল উপাদান ছিল অসম্প্রাদায়িক ইতিহাস চর্চা।
বাংলাদেশ যে মৌলিক মতাদর্শের উপর গড়ে উঠেছে, যে মতাদর্শকে ধারণ করেছে বাহাত্তরের সংবিধান সেই ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় তারা ইতিহাস চর্চা করেছেন। এছাড়া জনইতিহাস চর্চার ধারাও রয়েছে যেখানে দলিত, আদিবাসী তথা গণমানুষের কথা বলা হয়েছে। পরিশেষে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারা অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষ ও গণমুখী হতে হবে। সম্পাদনা: উম্মুল ওয়ারা সুইটি