ওয়াশিংটন পোস্টে ‘হলোকাস্টের আরব ত্রাতা’ এবং প্যারিসের প্রধান মসজিদ
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
আমেরিকান লেখক ও নিকট প্রাচ্য বিষয়ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রবার্ট স্যাটলফ ‘দ্য হলোকাস্টস আরব হিরোজ’ শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধ লিখেন, যা ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। সেটির গুরুত্ব সময় বিবেচনায় না হারিয়ে বরং বেড়েছে বলা যায়। কেননা এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমদের প্রতি অতিমাত্রায় রক্ষণশীল অভিবাসন নীতি আরোপের ফলে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রে ওই নিবন্ধটির মর্মার্থ উপলব্ধি যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতেও তার গুরুত্ব সমধিক। এক কথায়, চিরঞ্জীব সেই নিবন্ধ!
তাতে বেশ কয়েক বছরের গবেষণালব্ধ জ্ঞানে ওই লেখনিতে রবার্ট স্যাটলফ দেখিয়েছেন, নাৎসি জার্মানির এডলফ হিটলারের ইহুদি নিধনে অনুসৃত ‘ফাইনাল সল্যুশন’-এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সংঘটিত ‘হলোকাস্ট’কে মুসলিম বিশ্ব নিশ্চুপ ভুলেছে, তেমনি ইহুদি রক্ষায় আরবদের ভূমিকাকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান না দিয়ে নিজেদের গৌরবপূর্ণ অহংকারকে উজ্জীবনের সুযোগ হাতছাড়া করেছে। ফলে পবিত্র কুরআনের ‘যে একটি জীবন বাঁচিয়েছে, সে বিশ্বকে বাঁচিয়েছে’ তা ভিন্নভাবে ‘তুমি যদি একটি জীবন বাঁচাও, তাহলে তুমি বিশ্বকে বাঁচিয়েছো’ ইহুদি তিলমুদ গ্রন্থের এমন বর্ণনাকে পারস্পরিক ও মানবিকভাবে প্রগল্ভতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারেনি। একইভাবে হলোকাস্ট ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ‘ইয়াদ ভাষেম’ এবং সমপর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই ইহুদি রক্ষায় কোনো আরব রক্ষককে স্বীকৃতি দেয়নি। সেজন্য আরবদের উচিত নিজেদের ইতিহাসটি রোমন্থন করা, তাতে বিশাল আরব জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালেও কিছুসংখ্যক আরবদের কাছে তা গৌরবপূর্ণ হবে, অন্ততঃ ইতিহাস বিস্মৃতির চেয়ে তা ঢের ভালো।
রবার্ট স্যাটলফ লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই নাৎসি জার্মানির আগ্রাসন বিস্তৃত আরব ভূখন্ডের ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে ত্রিপোলি এবং কায়রোতে গিয়ে ঠেকেছিল, যেখানে পাঁচ লাখের অধিক ইহুদির বসবাস ছিল। যদিও নাৎসি বাহিনী ও সম্মিলিত বাহিনী অঞ্চলটি অধিককাল করায়ত্ত করেনি, তা সত্ত্বেও ১৯৪০ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের মে মাস অবধি নাৎসিরা ফরাসি ‘ভিঁচি ফ্রেঞ্চ’ এবং ইতালীয় ফ্যাসিস্ট ও কিছু আরব দালালদের সহযোগিতায় আইনগতভাবে ইহুদিদের সহায়-সম্পত্তিগত ক্ষতিসাধন করেছে। সেখানে ইহুদি নিধনে কোনো ‘ডেথ ক্যাম্প’ গড়ে না উঠলেও ১০০ অমানবিক শ্রমশিবির গড়ে ওঠে। তবে আরব ভূখ-ের আলজেরিয়া ও মরক্কোয় নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করে সম্মিলিত বাহিনী প্রথম ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ বা চিতাঘরের সন্ধান পায়। ইউরোপের অর্ধেক ইহুদির মাত্র ১ শতাংশ অর্থাৎ ৪-৫ হাজার ইহুদি আরব ভূখ-ে ছিল, তাতে সম্মিলিত বাহিনীর প্রচেষ্টায় ১৯৪৩ সালের মে মাসে ওই ভূখ-টি নাৎসি দখলমুক্ত না হলে আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনেসিয়া এমনকি মিসর ও প্যালেস্টাইনের ইহুদিরা ইউরোপের অনুরূপ ভাগ্যটি বরণ করত।
তথাপি ওই নিবন্ধে বলা হয়েছেÑ আরব ভূখন্ডে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসি মৃত্যু পরোয়ানাকালীন অনেক আরব জীবনবাজি রেখেই ইহুদিদের বাঁচিয়েছেন। তারা তাদের ঘরে ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছেন, মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করেছেন, নিজেদের রেশনের খাবার ভাগ করে ক্ষুধা মিটিয়েছেন এবং নাৎসি বাহিনীর আগমনের তথ্য দিয়ে সতর্ক করেছেন। মরক্কোর সুলতান ও তিউনিসের প্রশাসক উভয়েই নৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি বাস্তব সহযোগিতা জুগিয়েছেন। ভিঁচি নিয়ন্ত্রিত আলজিয়ার্সের মসজিদে শুক্রবারের খুতবায় ইহুদি সম্পদ হরণে নিষেধাজ্ঞার বাণী পড়ে শোনানো হত। এতে তিউনেসিয়ার সাফাক্সের ইয়াকব জ্রিভির মতে, ‘আরবরা ইহুদিদের সুরক্ষা করেছেন’। দেখা গেছে, শ্রমশিবির থেকে পালানো ৬০ জন ইহুদিকে তিউনিসের সি আলী সাক্কাত সম্মিলিত বাহিনী আসা পর্যন্ত লুকিয়ে রাখেন। আর মাহদিয়ার খালেদ আবদেলওয়াহাব বেশ কয়েকটি ইহুদি পরিবারকে রাতের অন্ধকারে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেন।
তবে ওই নিবন্ধের উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছেÑ ইউরোপের প্রভাবশালী আলজেরিয় আরব কূটনীতিক ও প্যারিসের প্রধান মসজিদের রেক্টর বা কর্মধ্যক্ষ সি কাদ্দোর বেনগাব্রিট একাই শতাধিক ইহুদিকে মসজিদে আশ্রয় দিয়ে ফ্রেঞ্চ পুলিশ ও গেস্টাপোদের কবল থেকে প্রাণে বাঁচান। এ ঘটনাটি ওই মসজিদের দুই পৃষ্ঠার একটি চিত্রকর্মে বিমূর্ত। এ ছাড়াও ক্যারেন গ্রে রুয়েল ও ডেবোরাহ ডুরল্যান্ড ডিসেইক্সের যৌথ রচিত ‘দ্য গ্র্যান্ড মস্ক অব প্যারিস’ বইয়ে বিধৃত হয়েছে।
তাই পরিশেষে রবার্ট স্যাটলফ এ যাবৎকালে একজন আরব প্রিন্সের হলোকাস্ট মিউজিয়াম পরিদর্শনের অভিব্যক্তিটি টেনে লিখেছেনÑ ‘খারাপ কাজ যেন ভালোতে বদলায়, ঘৃণা হোক ভালোবাসা এবং যুদ্ধ হোক শান্তি’।
ই-মেইল : নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স