বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভাষার সঠিক মর্যাদা না দেওয়ার কারণে সেই অহংকারের ভিত্তিটি হারিয়ে গেছে
আশিক রহমান: আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মধুর সেই ভাষার মর্যাদা দিতে চাইছিল না পাকিস্তানিরা। লড়াই করে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছি। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। কিন্তু রফিক, শফিক, সালাম, বরকতদের, জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষার মর্যাদা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমাদের উচ্চারণে, লিখনে যে বাংলা ভাষা এখন প্রচলিত তা মানসম্মত নয়।
তিনি বলেন, মানসম্মত বাংলার অভাব বাংলাভাষাকে নানাভাবে সঙ্কটাপন্ন করেছে। এর জন্য অবশ্যই দায়ী আমাদের ঐকান্তিকতার অভাবÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব পর্যায় বাংলাভাষার পরিচর্যার বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত। সরকারি ভাষায় বাংলা বিকৃত, বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহারে বাংলাভাষা অনেকটাই প্রমিত নয়। যার ফলে একটা নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাভাষার সঠিক মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছি এবং এর জন্য যার যে ভূমিকাটুকু পালন করার কথা ছিল, সে ভূমিকা কেউ পালন করেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে এই ইতিহাসবিদ বলেন, উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহারে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে। প্রতিবন্ধকতা হচ্ছেÑ মানসম্মত বাংলা পাঠ্যপুস্তক নেই। বাংলায় যে সমস্ত এ যাবৎ পাঠ্যপুস্তক বেরিয়েছে সেগুলো মানসম্মত নয়। এবং যারা লিখেছেন অনেক ক্ষেত্রেই গুণ, মানহীন লেখকেরাই এসব লেখা লিখেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রকাশকেরা সেই বইগুলো বাজারজাত করেন।
তিনি বলেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বাংলাভাষার জ্ঞানও অত্যন্ত সীমিত। বিশেষ করে বর্তমানে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় যারা পড়াশোনা করছে তাদের ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। যে কারণে তারা শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে এসেও মানসম্মত বাংলা লিখতে বা বলতেও পারছে না। কারণ প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মানসম্মত বাংলায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন না। ভাষার চর্চাও হচ্ছে না বা বাংলাভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চাও সঠিকভাবে হচ্ছে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাভাষার সঠিক চর্চা, ব্যবহার ও ভাষার মর্যাদা ধরে রাখার ক্ষেত্রে শিক্ষদেরও ভূমিকা আছে, প্রতিষ্ঠানেরও দা রয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে বাংলাভাষার মানসম্মত যে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয় তার সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার এবং পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করবার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে, শিক্ষকদেরকে প্রণোদনামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষকদের দিয়ে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক লিখে নেওয়া দরকার। আর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদেরও প্রমিত বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়। আমাদের শিক্ষকদের ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, সেখানেও একটা সমস্যা রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ভাষা নিয়ে আমাদের যে গর্ব, যে অহংকার ছিল সেটা এখন নেইÑ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের এ কথার সঙ্গে আমি একমত। কারণ আমরা ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবৃত্তিক একটা অহংকার সবসময় লালন করি ঠিকই কিন্তু ভাষার সঠিক মর্যাদা না দেওয়ার কারণে সেই অহংকারের ভিত্তিটি হারিয়ে গেছে।
পরিচিতি: শিক্ষাবিদ