মামলা করে লাভ হবে না,তারা আমাদের পাশে এখনো আছে : মোশাররফ হোসেন
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এটা বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ থাকলেও দেশে ও বিদেশে সব জায়গায় প্রমাণ হয়ে গেছে, এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। কোনো ষড়যন্ত্রও হয়নি। এটা নিয়ে যা হয়েছে এগুলো ছিল গালগল্প। আর মামলাও করা হয়েছিল গুজবের উপর ভিত্তি করে। আদালতের এই রায় সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও ন্যায় বিচারের পক্ষে রায় হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক বুঝতে পেরেছে তারা ওই সময়ে যে অভিযোগ এনেছিল তা সত্য ছিল না- এই কথাগুলো বলেছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব ও বর্তমান শিল্প সচিব মোশাররাফ হোসেন ভূঁইয়া।
তিনি আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে রোববার এক সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, তাদের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান এই ধরনের অভিযোগ তোলায় ও অবস্থান ধরে রাখতে না পারায় এটা তাদের ইমেজ সংকট তৈরি করেছে। তারা মিথ্যে অভিযোগ করে বলেও প্রমাণ হয়েছে। তবে আমি এখন আর এগুলো নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আমি মামলা করারও পক্ষে না। কারণ বিশ্বব্যাংক তো পুরোটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেনি। এই অভিযোগ নিয়ে কাজ করেছেন ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট ও সেখানকার ইন্ট্রিগ্রিটি বিভাগের কয়েকজন। কিন্তু আজ তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেই। তাদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারও মেয়াদ শেষ। এই অবস্থায় আসলে আমি মনে করি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। বরং সম্পর্কটা ভালো রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। বৈরীতা তৈরি করে সমস্যার সমাধান হবে না। তবে বিশ্বব্যাংককে বিষয়টা জানাতে হবে তারা যে ভুল করেছিল।
মোশাররাফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, একটি মিথ্যে অভিযোগের কারণে আমাকে ৪০ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা খুবই বেদনাদায়ক ও অপমানজনক। কারণ আমি তো অপরাধ করিনি। এটা প্রমাণও হয়েছে। তাহলে আমার প্রশ্ন কেন আমাকে কারাগারে রাখা হলো। কেন গ্রেফতার করা হলো?
তিনি বলেন, যদিও ওই সময়ের দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা আমাকে বলেছিলেন তারা নিরুপায়। তাদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু উপরের নির্দেশে কাজ করেছে সেটাও বলেছে। কিন্তু সেদিন তারা গ্রেফতারের কাজটা না করলেও পারতো।
মোশাররফ বলেন, দুদক এখনো যে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মানুষকে আমি এখনো এই সব গ্রেফতারের বিরুদ্ধে। এটাকে স্ট্যান্টবাজি মনে হয়। দুদক মামলা করার পর গ্রেফতার করে। আমি মনে করি এটা ঠিক না। কারণ সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয় না শেষ পর্যন্ত। তাহলে তদন্ত চলাকালীন একজনকে গ্রেফতার করে হয়রানি করার দরকার কি। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে দুদকের আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার বলেও আমি মনে করি।
মোশাররাফ বলেন, পেছনের দিনের কথা মনে করতে গেলে এটা বলতে হয় যে, যখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলো তখন আমাদের দেশের গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা হতো। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে তা বিচার করা হতো না। একটা কথা বললে সেই কথার মধ্য থেকে নেতিবাচক কথা বের করে এরপর প্রকাশ করা হতো। আমি একবার দুদকে গেলাম। সেখান থেকে নিচে নেমে মিডিয়াকে বললাম আমার সঙ্গে ও মন্ত্রীর সঙ্গে যারা কাজ পেতে আগ্রহী ওই সকল প্রতিষ্ঠানের ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এটাকে তারা প্রচার করলো অবশেষে সচিব স্বীকার করলেন, এসএনসিলাভালিনের প্রতিনিধির সঙ্গে সচিব আর মন্ত্রীর দেখা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে। এই যে প্রচারণা এটা তো পূর্ণাঙ্গভাবে করা হতো না। তিনি বলেন, এই রকম আরও অনেক ঘটনা আছে। প্রতিদিন যখন মিডিয়াতে খবর প্রকাশ করা হতো তখন সামাজিকভাবে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের হেয় হতে হয়েছে। কিন্তু দুদকে অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার পর আর সমস্যা হয়নি।
তিনি বলেন, আমি এই জন্য কৃতজ্ঞ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তার অনঢ় অবস্থান, কঠোর মনোভাব ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সব সময় বুঝিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়নি। তিনি কঠোর না থাকলে অনেক কিছু হতে পারতো। কোনোদিন এমনকি একটি মুহূর্তের জন্যও তিনি আমাকে, ওই সময়ের মন্ত্রী মহোদয় ও উপদেষ্টাকে সন্দেহ করেননি। প্রশ্নও তুলেননি। এই কারণে যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন টাকা নিবেন না বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে, তখন তো তিনি সবাইকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমাকেও মূল্যায়ন করেছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইমেজ অক্ষুণœ রেখেছে।
বিশ্বব্যাংকের ভেতরেও কেউ কেউ আমাদের বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে থাকতে পারতো তাহলো ভালো হতো। কিন্তু না থাকতে পারাটা দুঃখজনক। তারা ভাবতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে ফিরিয়ে দিবেন। কারণ তাদের কথা মতো সবভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ মিলেনি। কিন্তু এরপরও তারা বিশ্বাস করেনি। কেবল চাপ দিয়েই যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী কোনো চাপের কাছে হেরে যাননি।
মোশাররাফ হোসেন বলেন, ওই সময়ে এডিবি ও জাইকাও বলেছিল, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তটা ঠিক হচ্ছে না। আমি মনে করি বিশ্বব্যাংক শোনা কথার উপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাতে তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে বঞ্চিত হলো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের যারা ওই সময়ে দায়িত্বে ছিলেন তারা যদি এটাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতেন তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো।
কেউ কেউ আমাকে বলেছে মামলা করতে। কিন্তু মামলা আমি কার বিরুদ্ধে করবো? মামলা করতে গেলে মুখের কথায় হবে না। আইনিভাবে প্রমাণ লাগবে। সেটা হলো বিশ্বব্যাংক যে আমাকে আটকিয়েছে এই জন্য তো আমাকে প্রমাণ করতে হবে। সেটা প্রমাণ করা সহজ হবে না। কারণ তারাতো কেবল আমাকে টার্গেট করে কাজটি করেনি। কেবল অভিযোগ করেছে। তাছাড়া আমার পদত্যাগও চায়নি। ওই সময়ে বিশ্বব্যাংকের অলটারনেট ডাইরেক্টর আফসোস করে বলেছিল, বিশ্বব্যাংকের কয়েকজনের কথায় অভিযোগ আমলে নেওয়া হলো ও সরকার এই রকম একটা কা- করলো। সরকারি আমলাদের গ্রেফতার করলো। বিষয়টা সবাই সহজভাবে নেয়নি।
মোশাররাফ হোসেন বলেন, আসলে কানাডার আদালতে মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকও একটি শিক্ষা পেয়েছে। তারা অতীতের ভুল বুঝতে পেরে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সহযোগিতার হাত আরও বেশি প্রসারিত করবে সেটাই চাই। আমি তাদের বিচার চাই না।
তবে আমি বিচার চাই তাদের, যারা মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে রটনা রটিয়েছে। একচেটিয়া দেশের ইমেজের ক্ষতি করেছে তাদের।
সেদিন যদি বিশ্বব্যাংককে সরে যেতে না হতো তাহলে পদ্মা সেতুর কাজ ২০১৪ সালের শেষদিকে শেষ না হলেও ২০১৫ সালে হয়ে যেত। এতে করে এতদিন পদ্মা সেতু চালু হয়ে যেত। আমরা সেখান থেকে রাজস্ব পেতাম। কিন্তু এই অভিযোগের কারণে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে এখন বাংলাদেশের খরচ বেড়েছে। লোকসান হচ্ছে। একদিকে খরচ বাড়লো অন্যদিকে বাংলাদেশের যে টাকা ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে পদ্মা সেতু থেকে আয় হতে পারতো সেটা হলো না। এতে করে ক্ষতি হলো। এই ক্ষতি বাংলাদেশ কিভাবে পুষিয়ে নিতে পারে সেটা বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমি আবারও প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যখন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে মিডিয়া তোলপাড় তখনও তিনি আমাদের কিছু বলেননি। বিশ্বাস হারাননি। যখন তিনি পদ্মা সেতুর কাজের উদ্বোধন করেন তখন তিনি আমাকে, অর্থ উপদেষ্টাকে ও ওই সময়ের মন্ত্রীকে একসঙ্গে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যান। আমাকে ডেকে বলেন, তুমি সামনে আস। আমার কাছে বস। এই যে সম্মান তিনি আমাদের দিয়েছেন এটাও বড় পাওনা। সব মিলিয়ে আজকে ভালো লাগছে। পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে। দেরি হলেও আমরা বিশ্বের কাছেও প্রমাণ করতে পেরেছি এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আর সেটা আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থাই তদন্ত করেছে। সম্পাদনা: এনামুল হক