
১০ জনের বিষয়ে গণশুনানি করে ইসি গঠন করা যেত তড়িঘড়ি কমিশন গঠন করায় বিতর্ক চলছে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: রাষ্ট্রপতি ঘোষিত নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ এনে ইসির সমালোচনা করছে বিএনপি। পাশাপাশি সার্চ কমিটির আহ্বানে আসা বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন মহলও মনে করছে, তড়িঘড়ি না করে সার্চ কমিটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করে নাম ঘোষণা করতে পারতো। অথবা সংক্ষিপ্ত নামগুলোর উপর শুনানি করলে ইসি নিয়ে এই বিতর্ক এড়ানো যেত।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সার্চ কমিটি বিশিষ্ট নাগরিকদের ডেকে পরামর্শ নিলেও সেসব আমলে নেয়নি। রাষ্ট্রপতি যখন ৩১টি দলের সঙ্গে সংলাপ করলেন, তখন অধিকাংশ দল ইসি গঠনের আইন চেয়েছিল, সার্চ কমিটি নয়। কিন্তু তা করা হলো না। অনুসন্ধান কমিটির কারও কারও বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তিনি জানান, ওই সার্চ কমিটি যে ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ডেকে মতামত নিয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনি নিজেই ছিলেন। তিনি বলেন, কমিটির কিছু সদস্য হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাদের নাম দিয়েছে, তাদের নাম তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করেছে। একদিনও সময় নেয়নি। সেক্ষেত্রে হয়তো সাংবিধানিক কোনো ত্রুটি হয়নি। কিন্তু মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, সার্চ কমিটির তালিকার দশজনকে কিভাবে বাছাই করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতো না-যদি সংক্ষিপ্ত তালিকা আরেকটু যাচাই-বাছাই করা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ইসি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগে পর্যবেক্ষণ করি। কারণ একটি বিষয় ভালো হয়েছে, সার্চ কমিটি নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে মত নিয়েছেন। তারপর রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ দেওয়া তালিক থেকেই নতুন ইসি গঠন করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে ইসি রাজনৈতিক সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে কি না? তিনি ইসি নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, এখন রাষ্ট্রপতি চাইলে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন সম্ভব।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য গণভোটের বিকল্প নেই। সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইংল্যান্ড বের হওয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ব্রেক্সিটের ব্যাপারে ইংল্যান্ড সরকার একা সিদ্ধান্ত নেয়নি। জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। তারা গণভোটের আয়োজন করেছিল। জনগণ চায়নি ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকুক, ফলে ইংল্যান্ড সরকারও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর নাম থেকে ১০ জন বাছাইয়ের পর দ্রুত কমিশন গঠন সবার মধ্যে সন্দেহের খোরাক তৈরি করেছে। আমরা সব কিছু রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছি, এতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না। জনগণের ওপর কিছু বিষয় ছেড়ে দেওয়া উচিত। জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সার্চ কমিটির দেওয়া নাম থেকেই যে ইসি গঠন করতে হবে, সেটি মানতে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কিন্তু বাধ্য নন। এখানে মূল কথা হলো- রাষ্ট্রপতি যা-ই করেন, তা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই করতে হবে। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সেই দিক থেকে ইসিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ থাকবেই। তবে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই ইসি গঠন করা হয়েছে। কাজেই এখন তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করা হলো আমাদের দায়িত্ব। ইসি সব সমস্যার সমাধান নয়। সবার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা লাগবে। এই বিশ্লেষক রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, বিএনপিসহ সব দলের উচিত হবে রাষ্ট্রপতি যেভাবে ইসি গঠন করেছেন সেই ইসি মেনে নেওয়া। তাদের উচিত নির্বাচন হোক সে ব্যাপারে সহযোগিতা করা। কারণ ইসি নিয়ে বিতর্ক থাকলে নির্বাচন নিয়েও ভাবনা থেকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে নিশ্চয়ই সার্চ কমিটি খোঁজ খবর নিয়েছেন। ইসি নির্বাচনের উপায় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে দশজনের তালিকা তুলে দেন। ওই তালিকা থেকে সাবেক সচিব কে এম নূরুল হুদাকে প্রধান করে সেই রাতেই রাষ্ট্রপতির নতুন ইসি গঠন করে দেন। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সংবাদ সম্মেলন করে মনোনীত পাঁচজন এবং সার্চ কমিটির সুপারিশে থাকা বাকি সবার নাম ঘোষণা করেন।
