আইএসে যোগ দিয়ে নিহত এক তরুণের দুঃখিনী মায়ের আর্তি
আজাদ হোসেন সুমন : তিনি একজন মা। সন্তানহারা মা। সন্তানহারা মায়ের বেদনা কি কোনো ভাষার গাঁথুনি দিয়ে বর্ণনা করা যায়। জবাব হবেÑ না। আইএসে যোগ দিয়ে নিহত হওয়া এক তরুণের মা শোকে-দুঃখে মূহ্যমান না হয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। গড়ে তুলেছেন, ‘সোসাইটি এগেইনস্ট ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ নামে একটি সংগঠন। যার কাজ হচ্ছে জঙ্গি ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব আলী সিনেট অডিটরিয়ামের মঞ্চে এই মা বর্ণনা করেন নিজের একমাত্র সন্তানের আইএসে যোগ দিয়ে নিহত হওয়ার বেদনাবিধূর কাহিনী। অডিটরিয়ামে পিনপতন নীরবতা। তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত সালিহা বেন আলী বেলজিয়ামের নাগরিক। তিনি বলা শুরু করলেন, ‘আমার ১৮ বছরের সন্তান সাবরি আর দশটা তরুণের মতোই স্বাভাবিক ছিল। নিয়মিত স্কুলে যেত। তার মাথায় সারাক্ষণ নানা প্রশ্ন কিলবিল করত। এমন এমন সব প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গান ভালোবাসত। খেলাধুলাও করত নিয়মিত। ছবি তুলতে তো খুব ভালোবাসত। এই যে দেখুন ছবিগুলো। আমার সঙ্গে তুলেছে। মিলান যাওয়ার আগে এই ছবিটা তুলেছিল… স্কুলের ছবি এটা… এটা ওর বন্ধু… এই ছবিটায় বলছেÑ জাস্ট বি কুল ম্যান।
সালিহা বলে চলেন, একসময় সে স্কুলে বিরতি নিয়ে কাজে যোগ দিতে চাইল। মনে করল, সে কাজ পাবে না, পেলেও যা পাবে তা চাকরবাকরদের কাজ হবে। ভাবল, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। সুযোগ পেল না। ফায়ার ফাইটার হতে চাইল, সেখানেও সাবরিকে কেউ নিল না। বলল, লেখাপড়া শেষ করে আসতে। সাবরির মাথায় তখন নানা চিন্তা, নানা প্রশ্ন তখন থেকেই সে ধর্ম নিয়ে অনেকটা আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ সময়ই আমার ছেলে ভুল মানুষের খপ্পরে পড়ে যায়। মসজিদের কাছে, খেলার মাঠের কোনায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিছু লোক সাবরিকে ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। তারা ছিলেন ডাচ ও ফ্রেঞ্চভাষী। তারা অন্য ধর্মের নামে বিদ্বেষপূর্ণ কথা বলত। সাবরিকে সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য উসকানি দিত। তারা সব ঘটনার পেছনেই ষড়যন্ত্র খুঁজত। ঘটনাগুলো কিন্তু পুলিশের সামনেই ঘটছিল। কিন্তু ওই যে অধিকার ক্ষুণœ হবে, তাই পুলিশ কখনো এ ধরনের আলোচনায় হস্তক্ষেপ করেনি। একপর্যায়ে সাবরি মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। বলত, মসজিদে ঠিকভাবে নামাজ পড়ানো হয় না। গত আগস্টে সাবরি চলে যায়। এরপর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ‘আমাকে মাফ করে দাও, মা। আমি সিরিয়া এসেছি।’ আমি ফিরে আসার অনুরোধ করলে ছেলে বলে, এমন অনুরোধ করলে আর কেউ তা দেখে ফেললে আর কথা বলার সুযোগ পাবে না। ছেলের জীবন বাঁচাতে থেমে যাই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তিন মাস পর একটা ফোন আসে। সাবরির বাবাকে অপরিচিত কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনি আবু তোরাবের বাবা বলছেন? উত্তরে তিনি বলেন, না আমি সাবরি বেন আলীর বাবা। অপরপ্রান্ত থেকে অজ্ঞাতনামা জানায়, এইমাত্র আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে। খবর নয় তো যেন একটা ইলেকট্রিক শক আপাদমস্তক ঝাঁকুনি দেয়।
একমাত্র সন্তান হারিয়ে নির্বাক হয়ে যাননি এই মা। তিনি এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে যাচ্ছেন। সন্তান হারানোর বেদনা চেপে তিনি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কথা বলছেন কিশোর তরুণদের সঙ্গে, অভিভাবকদের সঙ্গে। যেন আর কোনো তরুণ দিকভ্রান্ত হয়ে জঙ্গিবাদে পা না বাড়ায়। যেন আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।