
সহীহ মুসলিম : ইমাম মুসলিমের অমর কীর্তি
মুফতী আজীজুল্লাহ কাসেমী
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যাবস্থা। এর উৎস কোরআন এবং হাদীস। হাদীস নিয়ে যুগে যুগে সংকলিত হয়েছে বহু গ্রন্থ। হাদিসের অন্যতম একটি গ্রন্থের নাম ‘সহীহ মুসলিম’। ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মুসলিম আল কুশাইরী আন নাইসাবুরী হলেন এর সংকলক। উজবেকিস্তানের নিশাপুরে ২০৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহন করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২৬১ হিজরির ২৬ শে রজব রোববার দিন বিকেলে। এবং নিশাপুরেই তাকে দাফন করা হয়।
তার অন্যান্য সংকলনের মধ্যে সহীহ মুসলিম হলো সবচে প্রসিদ্ধ ও গ্রহনযোগ্য। মুহাদ্দিসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোরআন মাজীদের পর পৃথিবীর বুকে বিশুদ্ধতম দ্বিতীয় গ্রন্থ হলো ‘মুসলিম শরীফ’। শক্তিশালি পরিকল্পনার পাশাপাশি অত্যন্ত যতেœর সাথে গুছিয়ে ইমাম মুসলিম তৈরি করেছেন সংকলনটি। উক্ত কর্মটি সম্পন্ন করতে তার সময় লেগেছে প্রায় পনের বছর। উক্ত গ্রন্থ সংকলনে তার পরিকল্পনা ও সযতœ সুন্দর বিন্যাসকে বিবেচনা করে তার যুগের পশ্চিমা বহু মুহাদ্দিস সহীহ মুসলিমকে সহীহ বুখারী’র উপর প্রাধান্য দিয়ে তাকে ‘শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তাদের অন্যতম একজন হাফিজুল হাদীস আবু আলী নায়সাবুরী বলেন: ‘আসমানের নিচে ইলমে হাদীস সংক্রান্ত ইমাম মুসলিমের কিতাব অপেক্ষা বিশুদ্ধতম কোন কিতাব নাই।’
হাদিসের এ গ্রন্থ সংকলনের ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিম তার একান্ত আস্থাভাজন ছাত্রদের সহযোগিতাও নিয়েছেন। তার ছাত্র আহমদ বিন সালামা বলেন, ‘ইমাম মুসলিমের সাথে তার ‘সহীহ’ সংকলনের ক্ষেত্রে আমি পনেরো বছর কাজ করেছি, এতে প্রায় ১২ হাজার হাদীস রয়েছে (পুনরুক্তসহ)। পুনরুক্ত বাদ দিলে হাদীসের সংখ্যা হবে প্রায় ৪০০০)।’
ইমাম মুসলিম একজন বড় মাপের ‘হাফিজুল হাদীস’ ছিলেন। তিনি তার মুখস্ত তিন লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে বিশুদ্ধ হাদীসের এ সংকলনটি তৈরি করেছেন। হাফিজুল হাদীস আবু কুরাইশ বলেন, ‘বিশ্বমানের হাফিজে হাদীস চারজন। এরপর তিনি ইমাম মুসলিমকে তাদের মধ্যে হিসেব করেন।’
ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত পরহেজগার ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। জীবনে তিনি কারো গীবত বা পরনিন্দা করেননি, কাউকে আঘাত করেননি, কাউকে গালি দেননি।
তার হাদীসের ওস্তাদদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া তামীমী, আহমদ ইবনে ইউনুস ও আহমদ ইবনে হাম্বলের মত অনেকেই রয়েছেন; যারা আপন যুগের ইলমে হাদীসের নক্ষত্র ছিলেন। পাশাপাশি তার রয়েছে প্রচুর ছাত্র। ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী তাদের একজন।
তার কিতাব ‘মুসলিম শরীফ’ কিছু বৈশিষ্ট্যে অনন্য। যেমন, এক: উক্ত গ্রন্থের মুকাদ্দামা বা ভূমিকা। যাতে তিনি গ্রন্থ লিখার উদ্দেশ্য, এতে ব্যবহৃত পরিভাষা, হাদীস গ্রহণের শর্ত ও নীতিমালাসহ ইলমে হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুই: তিনি এ গ্রন্থে সেসব হাদীস’ই এনেছেন যা তিনি তার ওস্তাদদের নিকট সরাসরি শুনেছেন বা পড়েছেন। তিন: একটি হাদীসের বিভিন্ন সূত্রকে এক জায়গায় সন্নিবেশ করেছেন। এবং শুধুমাত্র মারফূ’আত (রাসূল সা. থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত) এনেছেন। মাওকূফাত (সাহাবা-তাবেঈদের বর্ণনা) বা (মাকতূ’আত) বিচ্ছিন্নসূত্রের হাদীস আনেননি। এমনকি তিনি এ গ্রন্থটিকে হাদীস-ভিন্ন বিষয় থেকে মুক্ত রাখতে হাদীস থেকে বিধান নি:সারণ করে শিরোনামও আরোপ করেননি। (যেমনটি ইমাম বুখারী করেছেন।)
এছাড়াও হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে সুন্দর বিন্যাসরীতি ও চমৎকার উপস্থাপনার কারণে হাদীসের গ্রন্থসমূহের মাঝে উক্ত গ্রন্থটি বিশেষ মানে উন্নিত থাকার কথা আমরা ইতিপূর্বে জানতে পেরেছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের উক্ত গ্রন্থ থেকে অধিক পরিমানে উপকৃত হওয়ার এবং সুন্নাহসম্মত জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন। আমীন!
তথ্যসূত্র: তাহযীবুত তাহযীব। তাযকিরাতুল হুফফাজ, শরহুন নববী ‘আলা মুসলিম, ফাত হুল মুলহিম, আল ইমাম মুসলিম ওয়া সহীহুহু।
