গৃহশ্রমিকদের উপর নির্যাতন কবে বন্ধ হবে?
মো. ওসমান গনি
বাসাবাড়িতে যারা অতিরিক্ত লোক হিসেবে কাজ করেন তারাই গৃহশ্রমিক হিসেবে পরিচিত। গৃহশ্রমিক হতে পারে শিশু বা বয়ষ্ক লোক। তারা যে গৃহে কাজ করার জন্য চাকরি নেন কাকডাকা ভোর হতে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে তাদের কাজ। সংসারের এমন কোনো কাজ নেই যা তাদের দ্বারা করানো হয় না। তারপরও তারা গৃহমালিকের মন জয় বা সন্তুষ্ট করতে পারে না। মালিকপক্ষ চায় আরও কাজ। যে লোকটা গৃহপরিচারিকার কাজ করে সে বাঁচল কি মরল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের কোনো রোগ-শোকের খবর তারা জানতে চান না। যত অসুস্থই হোক তাকে কাজ করতেই হবে। মনে হয় তাদের কেনা গোলাম। এরপরও তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এমনভাবে নির্যাতন করা হয় যা দেখলে পরে কোনো সুস্থ মানুষও ঠিক থাকতে পারে না। কেন তাদের ওপর এমন অমানুষিক নির্যাতন? তারা তো মানুষ। তাদের দেহ তো রক্তমাংসের গড়া। তারা কোনো বাবা-মায়ের সন্তান। তাদের অপরাধ কি? তাদের অপরাধ একটাই তারা কেন গৃহপরিচারিকার কাজ করতে এলো। সেটা নিয়তির খেলা। সমাজের অসহায় পরিবারের লোকজন যখন সংসার চালাতে হিমশিম খায় তখন একটা পরিবার তার ছেলে বা মেয়েকে অন্য একটা পরিবারে কাজ করে খাওয়ার জন্য পাঠায়। তখন ওই পরিবার মন চাইলে তাকে মাসে সামান্য কিছু টাকা-পয়সা দেয় আর না হলে পেটেভাতে চলে তাদের জীবন। পারতপক্ষে তাদের বছরে তাদের কোনো ছুটি দেওয়া হয় না। যে পরিবারে কাজ করে সে পরিবারের লোকজন খাওয়ার পর কিছু থাকলে তা খেতে পারে। অনেক সময় তাকে না খেয়েও থাকতে হয়। তবে সব পরিবার না। কিছু কিছু পরিবারের বেলায় এমন আচরণ দেখা যায়। তারপরও চলে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন কোনো কোনো গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারাও যে মানুষ এ উপলব্ধিও হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে শিশু গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন যেভাবে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৭ শিশু গৃহপরিচারিকা নিহত হয়েছে নির্যাতনের শিকার হয়ে। ৮-১০ বছরের শিশুদের খুন্তি গরম করে ছেঁকা, হাত-পা থেঁতলে দেওয়াসহ এহেন নির্যাতন নেই যা থেকে তারা দূরে থাকছে। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তো নারী গৃহপরিচারিকাদের একাংশের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। যারা শিশুদের ওপর কথায় কথায় নির্যাতন চালায়, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন অসুস্থ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহপরিচারিকা বিশেষত শিশু গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে কেউই পিছিয়ে থাকছে না। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যারা জড়িত, তারাও জড়িত হচ্ছে নির্যাতনের মতো বর্বরতার সঙ্গে। বাদ যাচ্ছেন না ক্রীড়া জগতের নন্দিত খেলোয়াড়রা। মুখে যারা মানবাধিকারের বুলি আওড়ান তাদের অনেকের ঘর শিশু নির্যাতনের আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার। এদের এক বড় অংশকে প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশে শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকায় নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে তা ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোনো কোনো নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত আপোসের চোরাবালিতে তা ঢাকা পড়ে যায়। কারণ গৃহপরিচারিকার পক্ষে মামলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না অসহায় পরিবারের লোকজনের। গরিব গৃহপরিচারিকা ও শিশু শ্রমিকদের অভিভাবকরা মামলা চালিয়ে আরও হয়রানি হওয়ার চেয়ে আপোস করাকেই স্বস্তিদায়ক বলে মনে করেন। গৃহপরিচারিকা ও শিশু গৃহশ্রমিকদের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে কড়া আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। এ ব্যাপারে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া দরকার। আইন করে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হলে, নির্মমভাবে এত গৃহশ্রমিককে প্রাণ দিতে হতো না। তাই অবিলম্বে আইন করে এ শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান