‘ডুব’-এ আছে সবাই
অনির্বাণ বড়ুয়া: ডুব-এ ডুবে মরার অবস্থা এখন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের। বিগত দুই দিন থেকেই বাংলা চলচ্চিত্র বোদ্ধা, পরিচালক, দর্শক, হুমায়ূন পাঠক সাধারণ জনগণ সবার টাইমলাইনেই একটি টপিক আর তা হলো, ডুব সিনেমা কার জীবনের কাহিনী নিয়ে? পরিচালক ফারুকী বলছেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দূর দূরান্তের কোনো রিসতা নেই এই সিনেমার আর হুমায়ূনপতœী মেহের আফরোজ শাওন বলছেন, আমার কাছে তথ্য আছে সিনেমার কাহিনী হুমায়ূনের জীবনের ‘স্পর্শকাতর’ অধ্যায় নিয়ে। তাই তিনি সোজা সেন্সরবোর্ডে চিঠি লিখে বলেছেন এই সিনেমাকে ছাড়া যাবে না। হলোও তাই, সিনেমা সেন্সর বোর্ডও স্থগিত করলো তার অনাপত্তি পত্র। সেটি শোনে ফারুকী তো বটেই, সেই সঙ্গে অবাক হয়েছে সিনেমাটির কো-প্রডিউসার ও কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা হলিবলি নায়ক ইরফান খান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এটি জেনে আমি অবাক হয়েছি। এতে নিষিদ্ধ হওয়ার মতো কিছু নেই।
খবরটি বের হওয়ার পর ফারুকী-শাওন যেন হয়ে গেলো চুম্বকের দুই মেরু, দুই দিকেই সরে যেতে থাকে এক একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। কেউ বলছেন সিনেমা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন অপরাধ হয়েছে না হয়নি, যেখানে মেহেরজান ছাড়পত্র পেয়েছে, হলে চলেছে, সেখানে ডুব-এর এমন কী হলো? অপরপক্ষ বলছে, আমাদের কাছে তথ্য আছে এটা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, আর ফারুকী এই সিনেমা বানানোর জন্য অনুমতি নেয়নি। সোস্যাল মিডিয়ায় গত দুদিনের এই দুই পক্ষের সমর্থকদের মন্তব্যের সারমর্ম চলচ্চিত্র গবেষক ও সমালোচক শেরিফ আল শায়ার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সাদমান সাদেকের বক্তব্য থেকে করা যায়।
শেরিফ আল শায়ার লিখেছেন, “একটা ছবি না দেখে কিংবা চিত্রনাট্য না দেখে শাওন কী করে ভাবলেন সেটা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তৈরি করা। আর শাওন তাহলে স্বীকার করছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ‘স্পর্শকাতর’ অধ্যায়? ফারুকীর ‘ডুব’ চলচ্চিত্র আটকে দেওয়া বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল। যদিও এই ধরনের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক ঘটনা।”
“আমি ফারুকীর ছবি দেখে আলোচনা সমালোচনা করতে চাই। কার জীবন নিয়ে লেখা, কার জীবনে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সেসব প্রসঙ্গ টেনে আনা অবান্তর। কারণ আমরা সিনেমা দেখতে যাবো, হুমায়ূন আহমেদের জীবনী না। কারণ হুমায়ূনের জীবনে কী ঘটেছিল সেটা আমরা জানি। সব জেনেও আমরা হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবাসি। কারণ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ তার সৃষ্টি নিয়ে। আমি কখনও জানতে চাই নাই, হুমায়ূন কার জীবন তার গল্প উপন্যাসে টেনেছেন। তো ফারুকীকে ঘাটানোরও প্রয়োজন বোধ করছি না। হুমায়ূন আহমেদের জীবনে যা ঘটেছে তা বাংলাদেশের কোণায় কোণায় ঘটে। সেটা নিয়ে যদি ফারুকী ছবি নির্মাণ করেই থাকেন তো সমস্যা কোথায়?”
সাদমান সাদেক লিখেছেন, “আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বানাবেন, আর আন্তর্জাতিক আইন মানবেন না এটা কোন ধরনের জোচ্চুরি? সাহস থাকলে অনুমতি ছাড়া মাইকেল জ্যাকসন নিয়ে চলচ্চিত্র ব্যবসা করুনতো? চুরির মামলায় জেলে যাবেন। ফারুকী সাহেব নিজে বলেন এই চলচ্চিত্রের সাথে হুমায়ূনের সম্পর্ক নেই, আবার বাজারে কাটতি বাড়াতে এই চলচ্চিত্রেরই অভিনেত্রীকে দিয়ে বাজারে গুজব ছড়ান এটি হুমায়ূন আহমেদের উপরই চলচ্চিত্র। কী লোভ!”
“ধরা খেয়ে এখন ন্যাকামি চলছে। হুমায়ূনকে এতই ভালবাসলে তাকে নিয়ে ব্যবসা ফাঁদলেন কেন? তার সজ্ঞানে নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং পরিবারকে অসম্মান কেন? আপনার অপছন্দ হলেও এটিই সত্য শাওন ব্যতীত হুমায়ূন চরিত্র অপূর্ণ। তাই তার অনুমতি না নিয়ে এই চলচ্চিত্র বানিয়ে আপনি অন্যায় করছেন এবং আরো ভুল করেছেন শাওনকে সবার সামনে ভিলিফাই করেÑ হুমায়ূন ভক্তদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে। আপনার এই ব্যবসা বন্ধ করুন।”
বিতর্কটি যখন চলছিল তখনই অনলাইনে একটি খবর আসে যে ফারুকী নিজেই এই সিনেমা যে হুমায়ূনের জীবন থেকে নেওয়া সেটি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি যখনই মিডিয়াতে আসে তখনই মেহের আফরোজের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় এবং তিনি একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিকদের জানান, “নাম পরিবর্তন করে দিলেই আসল বিষয় পরিবর্তন হয়ে যায় না।” এখানে তিনি অবশ্য ফারুকীকে গুণী পরিচালক হিসেবেও আখ্যা দেন এবং যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করেই তিনি বলেন, এমন কোনো গল্প যেটা আমার পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা প্রচার করলে তার আপত্তি আছে।
যা হোক, বিতর্ক যখন চলছে তখন চলুন আমরা শুনে আসি তসলিমা নাসরিনের কথা, যাকে নিয়েও সত্য মিথ্যা মিশিয়ে সিনেমা বানিয়েছে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক কলামে তিনি ডুব বিষয়ে বলেন, “ফারুকীর ‘ডুব’ ছবির প্রধান চরিত্রের নাম জাভেদ হাসান। এটি হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয়। বায়োপিক দাবি করে ফারুকী কোনো মিথ্যে গল্প ফাঁদছেন না, তবে আপত্তি উঠছে কেন? ফারুকী বরং বায়োপিক দাবি না করেও হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সত্য গল্পটাই বলছেন। তিশা আর পার্নো যদি হুমায়ূন আহমেদের কন্যা এবং কন্যার বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, আমি তো বলবো, ওঁরা একটু বেশি বয়সেই ওদের অভিনয় করেছেন, বাস্তবে কন্যা এবং কন্যার বান্ধবীর বয়স তখন হয়ত আরো কম ছিল।”
ডুব নিয়ে আসলে কোনো দাবি তোলা কেন যৌক্তিক নয় তার ব্যাখ্যা দিতে তিনি বলেন তার ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নির্বাসিত’র কথা। তিনি বলেন, “ছবিটির শতকরা ২০ ভাগ আমার গল্প, ৮০ ভাগ বানানো। তার পরও সবাই জানে ওটি আমাকে নিয়ে তৈরি। নির্বাসিত যেদিন শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়, আমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। নির্বাসিতর ৮০ ভাগ আমার জীবনের কাহিনী নয়, সে কারণে ছবিটিকে আমার বায়োপিক হিসেবে অফিসিয়ালি দাবি করা হয়নি। নির্বাসিত ছবির প্রধান চরিত্রকে তসলিমা নামেও ডাকা হয়নি, তাঁকে ডাকা হয়েছে লেখিকা বলে, উনি বলে, তিনি বলে, মহিলা বলে। যদি তসলিমা নাসরিন হতো তার নাম, যদি ছবিটিকে আমার জীবন কাহিনী বলে অফিসিয়ালি প্রচার করা হতো এবং সে নামের লেখিকাকে দেখানো হতো এমন উদ্ভট কিছু করছে যা আমি কশ্মিনকালেও করিনি, আমার আদর্শ ও বিশ্বাসের বিপরীত কাজ যদি ছবির আমি চরিত্রকে দিয়ে করানো হতো, তবে আমি নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করতাম, মামলা টামলা কখনও কারো বিরুদ্ধে আমি করিনি, হয়তো নিরূপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নিতাম।”
এদিকে ফেসবুকে একজন প্রশ্ন তুলেছেন, কাকতালীয়ভাবে যদি কোনো সিনেমার কাহিনী হুমায়ূন আহমেদের জীবনীর সঙ্গে মিলে যায় তখন কী হবে?
মিলে গেলে যাই হোক না কেন, এই সময়ে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যে চাপে আছেন সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। একে একে সিনেমার অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, পার্নো মিত্র বলেছেন তাদের বলা হয়েছিল সিনেমাটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনের অংশ নিয়ে নির্মিত।
চলুন দেখা যাক, ফারুকী কী বলেন। ফারুকী স্ট্যাটাসে জানান এই বৈশাখেই মুক্তি পাবে সিনেমা। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, “হুমায়ূন কারো স্বামী হইতে পারেন, বাবা হইতে পারেন, কিন্তু হুমায়ূন নামে যে বিশাল আকাশ আমাদের ঘিরে রাখছে, এইটার মালিক কেউ না। জগতে সকল কিছুর মালকিন হওয়ার চেষ্টা করা বোকামি।”
ফারুকীর পূর্ণ স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
“ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে আনন্দবাজারের আগেও একটা বিখ্যাত ইংরেজী পত্রিকার একজন সাংবাদিক আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের দিকে এই গুজব বিষয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তখন উনার সাথে প্রায় ঘণ্টাখানেক আকুতি মিনতি ঝগড়া করে তাকে এই রিপোর্ট করা থেকে বিরত রাখি। কিন্তু আনন্দবাজারে কেনো গুজব গেলো, এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ছবির তো একটা প্রযোজক আছে কলকাতায়, নাকি? সব কিছু কি আমার কথা মতো চলবে? তার পরেও অফিসিয়ালি আমার বক্তব্য কি সেটা আনন্দবাজারকেও বলা হয়েছে যে, এটা বায়োপিক না। এবং সেটাই ছাপা হইছে।”
“কিন্তু এখন তো ছবিই তৈরি। আনন্দ অথবা বেদনার বাজারে বায়োপিক বলা হইছে কি হয় নাই সেটা কষ্ট করে খোঁজার দরকার কি? ছবিতেই তো উত্তর আছে। ছবিটা জাভেদ হাসান, সাবেরী, মায়া এবং নিতুর।”
“ডিসক্লেমারে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এটা একটা ফিকশনাল স্টোরি। এর সাথে জীবিত অথবা মৃত কারো কোনো সম্পর্ক নাই। আর এতে কাউকে ছোটো করা হইছে না বড় করা হইছে সেটা তো ছবি দেখলেই বোঝা যাবে। দর্শকরা যার যার বিচার বুদ্ধি খাটিয়েই বুঝতে পারবে। জীবনের জটিল অংক, অসহায়ত্ব এই সবে অবগাহন করার মতো ম্যাচুরিটি এবং সেন্সিবিলিটি আমাদের দর্শকদের আছে। লেট দেম ওয়াচ এন্ড ফিল।”
“আমাদের তো ছবি দেখাইতে কোনো ভয় নাই। হুমায়ূন ভক্তদেরও নিশ্চয়ই ছবি দেখতে ভয় নাই। তবে ভয়টা কার? কেনো? সিনেমা সকল আইন কানুন মেনে দর্শকের জন্য বানানো হইছে তারা দেখবেই। এবং এই বৈশাখেই দেখবে।”
“পাদটীকা : আমার ছবির বাইরে একটা অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করি। আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো দেখলে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদের জীবন শুরু হইছে পঞ্চাশ বছর বয়স থেকে । তার কোনো অতীত নাই। আগের কোনো স্মৃতি নাই। ভাইরে, পঞ্চাশের পরে যেমন তার একটা জীবন আছে, পঞ্চাশের আগেও একটা আছে। এই স্মৃতিমোচন প্রকল্পের অংশীদার হওয়াটা ঠিক না মনে হয়।”
“আরেকটা কথা, হুমায়ূন কারো স্বামী হইতে পারেন, বাবা হইতে পারেন, কিন্তু হুমায়ূন নামে যে বিশাল আকাশ আমাদের ঘিরে রাখছে, এইটার মালিক কেউ না। জগতে সকল কিছুর মালকিন হওয়ার চেষ্টা করা বোকামি।”