উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার চান বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা
এস এম নূর মোহাম্মদ: নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সন্তোষজনক অবস্থায় থাকলেও উচ্চ আদালতে এখনো বেশির ভাগই ইংরেজি। যদিও অনেক বিচারপতিই মাঝে মধ্যে বাংলায় রায় দিচ্ছেন। তবে সব মহলের দাবি সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার।
আদালতের আবেদন ও রায় সাধারণত বিচারপ্রার্থী এবং আইনজীবীদের পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতে আইনজীবীরা ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও অনেক ক্ষেত্রেই বিচারপ্রার্থীরা তা বুঝতে পারেন না। যার কারণে মামলায় হেরে যাবার কারণ সঠিকভাবে জানতে পারেন না বিচারপ্রার্থীরা। অনেকের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীও তার মক্কেলকে সঠিক তথ্য জানাতে চান না। তবে বাংলায় রায় হলে সহজেই সেটা বুঝতে পারতেন বিচারপ্রার্থী।
উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আমরা এ ভাষায় কথা বলি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হওয়া আমাদের সবার দাবি। কিন্তু যত দ্রুত এটা
হওয়া উচিৎ ছিল সেটা হচ্ছে না। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি আসলেই এ দাবি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, ভাষা ও দেশের প্রতি যে ভালবাসা থাকা উচিৎ ছিল অনেকেরই সেটা নেই। যার কারণে এখনো এটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমি আইনজীবীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার জন্য বলেছি। আমরা চাই উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন হউক।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, উচ্চ আদালতে এখন মোটামুটি বাংলা ভাষার প্রাধান্য এসে গেছে। আইনজীবীরা বাংলাতেই বলেন এবং বিচারপতিরাও প্রশ্ন করেন। তবে আবেদনগুলো ইংরেজিতে লিখতে হয়। তবে বাংলায় লিখলে গ্রহণ করা হবে না এমনটি নয়। তাই এটিও ধীরে ধীরে বাংলায় হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলায় রায় লেখা শুরু হয়েছে। আশা করি কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলার প্রাধান্য চলে আসবে। আমরা আইনজীবীরা বাংলায় রায় দেওয়াকে স্বাগত জানাই। আমরা উচ্চ আদালতের রায়ের (সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন) বাস্তবায়ন চাই। তবে এ রায় বাস্তবায়ন না হলে সে ক্ষেত্রে হয়তো আইনজীবী সমিতি পদক্ষেপ নিবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, আমি মনে করি বাংলা ভাষা প্রচলন আইন যথাযথভাবে পালন করা উচিৎ। উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। আইনের সব ইংরেজিতে। তার পরও বিচারপতিরা যদি বাংলায় রায় লেখা শুরু করেন প্রথম দুই এক বছর কষ্ট হবে। তবে একসময় সেটি এত কষ্ট হবে না।
তিনি বলেন, মাতৃভাষায় রায় লিখলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বিচারপ্রার্থীরা। তারা বুঝতে পারবে কি কারণে হারলো বা জিতলো বা দুর্বলতা কোথায় ছিল। আমি মনে করি বিচারপতিরা একটু কষ্ট করলে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন খুব সহজ হবে।
এছাড়া জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, সংবিধান এবং অন্যান্য আইনে রাষ্ট্রের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। সে কারণে বাংলায় সব কিছু লেখার বাধ্য বাধকতা থাকলেও সর্বোচ্চ আদালতে সকল বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বিচারপতি বাংলায় চমৎকার রায় দিচ্ছেন। কিন্তু অনেকেই দিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই। আইন অনুযায়ী দিতে পারেন। দেওয়ার মতো সুযোগও আছে। সকল বিচারপতি যদি মন মানসিকতায় এটা পোষণ করেন, যে বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী সেটাকে গ্রহণ করতে হবে। তাহলে আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যারা দিচ্ছেন না প্রশাসনিকভাবে প্রধান বিচারপতিরও দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়টি দেখার।
তিনি আরও বলেন, বাংলা ভাষা প্রচলনের যে আইন রয়েছে সেটা কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, কারা করছেন না এটা প্রধান বিচারপতিকেও দেখতে হবে। আমরা আশা করি তড়িৎ গতিতেই প্রধান বিচারপতি বিষয়টি দেখবেন এবং অন্য বিচারপতিরাও দেখবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২নং আইন) জারি করা হয়। এর ধারা ৩-এ বলা হয়েছে, “৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং আইনগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হবে।
এছাড়া বিষয়টি নিয়ে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রুল জারি করেন আদালত। যাতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
তার আগে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভাষা দূষণ নদী দূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওইদিনই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি আর যাতে কোনো আঘাত না আসে সেটি নিশ্চিত করতে বলেন। সম্পাদনা: এনামুল হক