বিতর্কিত গ্রন্থ ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’ ১৯৬৭ সালেই জে. জিয়া, খালেদ ও মঞ্জুর বলতেন ‘আমাদের দেশে… পরে পাসপোর্ট’ নিয়ে আসতে হবে
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
গত বছর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ‘করাচি কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ কর্তৃক শিক্ষাবিদ ডক্টর জুনায়েদ আহমদ রচিত বিতর্কিত গ্রন্থ: ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’ বা ‘বাংলাদেশ সৃষ্টির পৌরাণিকতা উচ্চরবে বিদীর্ণ’ উন্মোচন নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে সমালোচনা শুরু হয়েছে। তার কারণ, গ্রন্থটির কিছু কপি কে বা কারা পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রেখে গেছে, যার কয়েকটি কপি নাকি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তাই অনলাইন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই গ্রন্থের উন্মোচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রায় পৌণে দ্-ুঘণ্টার একটি ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে রয়েছে; এমনকি উন্মোচনের পরদিন পাকিস্তানের অন্তত তিনটি দৈনিক পত্রিকা ডন, নিউজ ও বিজনেস রেকর্ডার যথাক্রমে শিরোনামপূর্ণ সংবাদ ছেপেছে: ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব ঢাকা’ বা ‘ঢাকার অত্যুৎসুক ঘটনাবলী’, ‘বুক ডিবাঙ্কিং ফোরটিন মেজর মিথস অ্যাবাউট ফল অব ঢাকা লাউঞ্চড’ বা ‘ঢাকা পতনে চৌদ্দ পৌরাণিক খোলসমুক্তির গ্রন্থ প্রকাশনা’ এবং ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড লাউঞ্চড’ বা ‘বাংলাদেশ সৃষ্টির পৌরাণিকতা উচ্চরবে বিদীর্ণ গ্রন্থের প্রকাশনা’। তাতে ডন লিখেছেÑ ‘সামরিকজান্তা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কোচ্ছেদ ঘটিয়েছে’। নিউজ বলেছেÑ ‘গ্রন্থটি বাংলাদেশের বিচ্যুতি বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বর্ণনার জবাবে পাকিস্তানের বর্ণনা’। আর বিজনেস রেকর্ডার লিখেছেÑ ‘বইটি পাকিস্তানি ইতিহাসের মর্মান্তিক অধ্যায়সহ শুধু ভূখ- নয়, বরং পরিবার-পরিজন, সততা, বিশ্বাস, সম্মান ও পরিচয় হারানোর অনুভূতিটি তুলে ধরেছে’।
তবে ইউটিউবের ওই ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, করাচির মেরিয়ট হোটেলে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপবিষ্ট থেকে গ্রন্থটির উপর আলোচনা করেন লেখক নিজে এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মঈনুদ্দিন হায়দার, সাবেক নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল শহিদ করিমুল্লাহ, সাবেক রাষ্ট্রদূত শহিদ আমিন, শিক্ষাবিদ ডক্টর হুমা বাকাই ও আইনজীবী সুয়া-উন-নবী। তাদের প্রথমজন রাষ্ট্রপতি জিয়া, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও আবুল মঞ্জুরের সতীর্থ এবং পরের নৌবাহিনী প্রধান ও আইনজীবীদ্বয় একাত্তরে বাংলাদেশে যথাক্রমে নৌ-কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তাদের প্রত্যেককে গ্রন্থটির আলোকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভারতের সম্পৃক্তি, মুক্তি বাহিনীর সৃষ্টি, অনুত্তম সামরিক নেতৃত্ব ও রাজনীতিকদের অসততাকে নানাভাবে তুলে ধরেন। একইসঙ্গে বলেন, সেসময় ঢাকায় সফররত ইরানের রেজা শাহ পাহলভীর সঙ্গে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন, যা গণমাধ্যমে কখনো প্রকাশ পায়নি। তবে লেখকসহ অপরাপর বক্তারা ২০০৪ সালে প্রকাশিত পরিশিষ্টহীন হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ক সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেন।
এতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মঈনুদ্দিন হায়দার বলেন, জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তিনি একই কক্ষে কাজ করতেন এবং জিয়ার পোস্টিং চট্টগ্রামে হলে তার বিক্রি করে যাওয়া আসবাবপত্রের একটি টেবিল ল্যাম্প কিনেন, যার বাল্বটি বেগম জিয়া দেননি। তার ভাষায়, ১৯৬৭ সালেই জিয়া, খালেদ ও মঞ্জুর সতীর্থ হওয়া সত্ত্বেও বলতেন, আমাদের দেশে বেড়াতে আসলে না, পরে পাসপোর্ট নিয়ে আসতে হবে। সেটা থেকেই বোঝা যায়Ñ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা তখন থেকেই উদগ্রীব।
এডমিরাল শহিদ করিমুল্লাহ বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার মতো ভারতীয় ইন্ধন এখন বেলুচিস্তানেও কাজ করছে। তিনি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবসম্মত উল্লেখ করে বলেন, ইসলামই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ককে অটুট রেখেছিল, অন্যথায় ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সবই ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সেখানে দুই পক্ষের ভ্রান্তিই রক্তক্ষয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।
রাষ্ট্রদূত শহিদ আমিন বলেন, বগুড়ার তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাকে বলেছেন ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’ এমন ঘোষণায় ছাত্রনেতারা প্রতিবাদী হলে জাতির পিতা কায়েদে আজম বলেছিলেন সেটাই প্রতিক্রিয়া হলে তোমাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনেও আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি আরো বলেন, ইন্ধিরা গান্ধী বাংলাদেশ সৃষ্টিতে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা ভ্রান্ত; কেননা বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গীভূত না হয়ে বরং একটি পৃথক ইসলামী রাষ্ট্র হয়েছে। তথাপি তিনি বলেন, বাঙালিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি মেনে নেওয়া হলে এই বিচ্ছেদ রুখে দেয়া যেত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তা অনুধাবন করেনি; বরং বঞ্চনার অনুভূতিই পৃথক রাষ্ট্র গঠনে বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আর জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাধাগ্রস্ত করাসহ সত্তরের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন।
ডক্টর হুমা বাকাই বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই কখনো আর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানই পাকিস্তানের সমালোচক। ভারতের অনিরাপত্তাই সেটিকে প্রণোদিত করেছে। সে জন্য ডক্টর জুনায়েদ আহমদের বইটি বাংলাদেশ ও ভারতের অভিযোগকে খন্ডন করে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের স্বরূপটি তথ্য-উপাত্তে তুলে ধরেছে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে আরো গবেষণার স্পৃহাকে সঞ্চারিত করবে।
আইনজীবী সুয়া-উন-নবী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বার্থে বাংলা শিখেছিলেন। সেখানে বৈষম্য করা হয়েছে সন্দেহ নেই। তাই ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কটি ফিরে পেতে আবেগতাড়িত একটি উর্দু কবিতা আবৃত্তি করে নিজের বক্তব্যটি শেষ করেন।
পরিশেষে লেখক ডক্টর জুনায়েদ আহমদ আলোচকদের ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বলেন, একাত্তরের ঘটনাবলী নিয়ে ভিত্তিহীন অপপ্রচারণায় পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ইমেজটি কলঙ্কিত হয়েছে। তাতে নিজের মা-বাবার মৃত্যুদিবসটি যতটা না ব্যথিত করে, তার চেয়ে বেশি ব্যথিত করে ১৬ ডিসেম্বর। সে জন্য কানাডার নাগরিকত্ব বিসর্জন ও সন্তানদের ছেড়ে নিজের জন্মভূমির সেবায় ফিরে এসেছেন এবং এ গ্রন্থটি তারই ক্ষুদ্র প্রয়াস। তিনি বলেন, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এই সুদীর্ঘ সময়ে বাঙালিদের প্রশাসনযন্ত্রে যথাযথ স্থান করে দেয়া হয়নি। না ছিল মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব কিংবা স্বরাষ্ট্র সচিব। সেই বঞ্চনার অনুভূতিই তাদের মাঝে প্রগাঢ় হয়েছিল। তাই ‘সাকুত-ই-ঢাকা’ বা ‘ঢাকা পতন’ বিষয়ে আমার এই গ্রন্থে ‘সত্যাসত্য’ তুলে ধরেছি। ধারাবাহিকভাবেই তাতে প্রতিটি চরিত্র, তাদের ষড়যন্ত্র, তাদের রোমাঞ্চহীনতা কিংবা ব্যর্থতা সবই স্থান পেয়েছে। ভারত সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছে। সে জন্যই ইন্ধিরা গান্ধী বলতে দ্বিধা করেননি ‘হাজার বছরের প্রতিশোধটি নিয়েছি, দ্বি-জাতিতত্ত্ব বঙ্গোপাসাগরে নিমজ্জিত হয়েছে’। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ‘ওআইসি’ সম্মেলনে মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেড় ঘণ্টার ‘অবুঝ’ আরবি বক্তব্যের ফলশ্রুতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বীকৃতি না দিলে তাইওয়ানের মতোই অস্বীকৃত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিবেচিত হতো। সেজন্য আরও পরে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন, এই গ্রন্থটি ‘সত্য উন্মোচন’ করে ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন’ ঘটাবে।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স