স্থানান্তরের বিরোধিতায় বিস্মিত বিশিষ্টজন রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান ও বসবাসের উপযোগী করা হচ্ছে ঠেঙ্গারচরকে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের ঠেঙ্গারচরে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সমর্থনের কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি ওই চরকে মানুষের বসবাস উপযোগী করতে যা যা প্রয়োজন তাই করার পরিকল্পনা দেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। কক্সবাজারের টেকনাফে ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গারা যেভাবে বসবাস করছে তা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের হুমকি হয়ে উঠেছে। পুনর্বাসনে রোহিঙ্গাদের জন্য আরও উন্নত জীবনের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ও জনবসতিতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অন্যত্র স্থানান্তরের পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ভিতর থেকে এই স্থানান্তরে যারা বিরোধিতা করছেন- তাদের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন নিয়ে ঠেঙ্গারচরের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বসবাসের উপযোগী করতে কি প্রয়োজন সে বিষয়ে পৃথক প্রতিবেদন করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, চরটির উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেবে সরকার। এ ব্যাপারে দাতা সংস্থা ও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করবে। তাদের কোনো পরামর্শ থাকলে সেটিও গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রীরা বিশ্ব নেতাদের সমর্থন নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গারা অস্থায়ীভাবে অবস্থান করবেন। পরে সেখান থেকেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। অবস্থানকালীন সময় রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করবে সরকার। ওই দ্বীপে নেয়ার আগে আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করবে, যাতে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, এখানে রোহিঙ্গাদের বাস দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সীমান্ত এলাকায় বাস করায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ও অপরাধীরা এদের অস্ত্র ও মাদক চোরা চালানে ব্যবহার করছে। এদের মাধ্যমে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এসব চোরা চালান চালাচ্ছে। মিয়ানমারে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী দল আছে তারাও এসব রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। বিরোধিতার সুযোগ এখানে নেই। কারণ, কক্সবাজার বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও শরণার্থী-মানবপাচার গবেষক জাকির হোসেন বলেন, ঠেঙ্গারচর বা অন্য যেখানেই নেওয়া হোক না কেন- কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সরাতে হবে। কারণ দিনে দিনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেভাবে বাড়ছে, তাতে পর্যটন কেন্দ্র তো দূরেই থাক, সাধারণের বসবাসের উপযোগীও থাকবে না এই এলাকা। একসময় কক্সবাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্য নিজেদের যোগান মিটিয়ে এক থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন রপ্তানি করা যেত। কিন্তু এখন এই পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে- বলেন গবেষক জাকির হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা রাখাইনেই ফিরে যেতে চায়। সেটা তাদের জায়গা। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার কাজ হবে, মিয়ানমারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে তারা বিরোধিতা করেত পারে না। তবে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে এটা অবশ্যই স্থায়ী যেন না হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের চিরতরে থাকতে দেওয়া হবে না, কারণ তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রোহিঙ্গাদের এখনই স্থানান্তর করা হচ্ছে না। তাদের পাঠানোর আগে অবকাঠামো নির্মাণ ও জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। এটা নিয়ে কারো উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। বিরোধিতাকারীদের আগে দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে পরামর্শ দেন সেতু মন্ত্রী। তিনি বলেন, সেখানে কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ তৈরি করবে সরকার এবং এসব সুবিধা সম্বল করেই ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তর করতে হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে মিয়ানমারের অবৈধ নাগরিকদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে অস্থায়ী ক্যাম্পে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঠেঙ্গারচরে কাঠামো তৈরি করার কাজ চলছে। তবে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পাঠানোর কাজ শুরু করতে সময় লাগবে৷ কিন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে সেখানে থাকবে এবং আমরা চাইবো মিয়ানমার সরকার যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফেরত নেবে।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের প্রায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৫৩০ জন রোহিঙ্গা পরিবারসহ উখিয়া, টেকনাফ ও রামু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। এ সময় সরকার আশ্রয় কেন্দ্র খোলে এসব রোহিঙ্গাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। পরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে সরকার সক্ষম হলেও উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গা রয়ে যায়। সরকারি নিবন্ধিত ১ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং সরকারি বনভূমির জায়গা দখল করে অবস্থান করছে। টেকনাফের লেদা এলাকায় বস্তি করে বাস করছেন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।