বাংলাদেশ সৃষ্টি নিয়ে বিতর্কিত গ্রন্থটি না মিললেও লেখকের মুখবন্ধটি পাওয়া গেছে! পাকিস্তান একাত্তরের দুষ্কর্ম থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
পাকিস্তানের শিক্ষাবিদ ডক্টর জুনায়েদ আহমদ রচিত বিতর্কিত ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’ গ্রন্থটি পাওয়া না গেলেও অনলাইনে সেটির প্রকাশনা সংস্থা করাচির এজেএ পাবলিশার্সের ওয়েবসাইটে লেখকের মুখবন্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কথিত নেতিবাচক বাণীসমূহ রয়েছে। তাতে নিউজ ও ইভেন্টসহ গ্যালারি সেকশনে গ্রন্থটির উপর ‘দুনিয়া’ টেলিভিশনে ‘টুনাইট উইথ মঈদ পীরজাদা’ অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপসহ প্রকাশনা উৎসবের ছবি ও পুরো অনুষ্ঠানের প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার ভিডিও ক্লিপটি স্থান পেয়েছে। ওই ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, লেখক ডক্টর জুনায়েদ আহমদ পাকিস্তানের একজন পরিচিত শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরামর্শক। সত্তরের দশকে কানাডার কনকোর্ডিয়া ও ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থব্যবস্থা ও নীতিসংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে দুই দশকের উপর কানাডা ও পাকিস্তানে অধ্যাপনা করেছেন। এছাড়া গত তিন দশক ধরে পাকিস্তানের প্রথিতযশা ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে চৌদ্দশতের অধিক গবেষণাকর্ম সম্পন্নসহ সম্প্রতি বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ে তার দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের সমস্যাসঙ্কুল বিষয় নিয়ে গবেষণাতাড়িত। তিনি করাচি কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য।
ওই গ্রন্থে বাংলাদেশ বিষয়ে কথিত নেতিবাচক বাণীর মাঝে রয়েছেÑ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী ও মোরারজি দেশাই, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল জেড এ খান, সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার শওকত আলী, মার্কিন প্রয়াত কূটনীতিক আর্চার ব্লাড, ভারতের বিজেপি নেতা এল কে আদভানি এবং ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংবর্ধনা বিষয়ে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিতের অভিব্যক্তি, যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতীয় উদ্দেশ্য ও ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে তার মতো করে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
লেখক ডক্টর জুনায়েদ আহমদ ওই গ্রন্থে নিজ মুখবন্ধে লিখেছেনÑ পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি বেদনাত্মক ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ৩৪ হাজার সৈন্য একীভূত পাকিস্তানের স্বপ্নটি জলাঞ্জলি দেয়। সেটা কেবল মিলিটারির নয়, বরং সকলেরই ব্যর্থতা ছিল। রাজনীতিকরা যেমন বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তাকে অটুট রাখেনি, তেমনি ভারত ও ক্রোনিদের অপপ্রচার গণমাধ্যম রুখেনি, কূটনীতিকরা একাত্তরের রাজনৈতিক সংকট বিশ্বের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরেনি এবং প্রতিরক্ষকরা ঘরে-বাইরের শত্রু থেকে আমাদের আদর্শ ও সীমান্ত রক্ষায় ব্যর্থ হন।
তথাপি ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো পাকিস্তান সেই ব্যবচ্ছেদ যাতনায় পিষ্ঠ। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বরের দুঃখ, বেদনা ও গ্লানি আমাদের অনেককেই শোকাহত করে। প্রতিটি মহান জাতি শোকের পাশাপাশি অতীত থেকে শিক্ষা নেয়, কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে দুষ্কর্মের শিক্ষাটি নিতে পারিনি। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল আপসকামিতায় নিমজ্জিত। অপদস্তের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও অকার্যকর পুরনো নীতি ও আচরণে রয়েছি সম্পৃক্ত। ফলশ্রুতিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চক্রান্তে পাকিস্তানের একতা, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব বিপন্ন।
একাত্তর নিয়ে এ পর্যন্ত বিশ্বের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সামরিকব্যক্তি, সাংবাদিক, কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা দায়সারাগোছের বিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আদ্যপান্ত বর্ণনা অনুপস্থিত। সেই কারণে এই গ্রন্থটি বস্তুনিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়াসে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে তুলে ধরেছে। হঠাৎ করেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ ঘটেনি, বরং তা ধারাবাহিক সূত্রপাতে ঘটেছে।
এই গ্রন্থটি ঐতিহাসিক, সামাজিক, কুশলীক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক শেকড়ের সন্ধানে পাকিস্তানের অলৌকিকতাকে তুলে ধরেছে। তদুপরি ভারতের প্ররোচনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচলিত পৌরাণিকতাকে তা চিহ্নিত করেছে। মোট আটটি অধ্যায়ে একাত্তরকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন: আগরতলা ষড়যন্ত্র, মুক্তিবাহিনী, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধাপবাদ, ত্রিশ লাখ গণহত্যা, ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তানের অভ্যুদয়, অখ- ভারত ধারণা, পৃথক ভূখ- হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি, ভাষা-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, ‘ইন্ডিয়া মেশিনেশন্স’, মুজিব-মুক্তিবাহিনী ভারত একনিষ্ঠতা, একাত্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জাতিসংঘে ভুট্টোর ভূমিকা, ভারতের সমর্থনে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা, ব্যবচ্ছেদোত্তর একাত্তর, ভুট্টোর বাংলাদেশ স্বীকৃতি এবং সবশেষে রক্তস্নাত পাকিস্তানের জন্য জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্তবলীসহ পাকিস্তান অবজারভার, ডন, জং, টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, লন্ডন টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউজউইক, টাইমস ও ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের আলোকে পরামর্শ হিসেবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর উপায়ান্তর তুলে ধরা হয়েছে।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স